সরল প্রাণে বিশ্বাস করুন, নাম আর ভগবান এক। ভগবানই নাম হইয়া ভক্ত হৃদয়ে বাস করেন।

 ঠাকুর! বসুদেব তো শ্রীকৃষ্ণকে বুকে করে কারাগার হতে বের হলেন, কিন্তু আমরা করব কি?

“সরল প্রাণে বিশ্বাস করুন, নাম আর ভগবান এক। ভগবানই নাম হইয়া ভক্ত হৃদয়ে বাস করেন। যেই নাম-সেই ভগবান। নাম আর ভগবান এক। যেই নাম-সেই কৃষ্ণ। আপন প্রাণেরে নামের সঙ্গে যুক্ত করিবেন। প্রাণ বলিতে একটা অব্যক্ত সত্যচৈতন্যবোধ বুকে ফুটিয়া উঠে। এই অনুভূতিকে নামের সহিত যুক্ত করিয়া দিতে হইবে। সর্বদা ভগবান প্রাণরূপে গতাগতি করেন, ইহা সত্য। নাম নিয়া পড়িয়া থাকিলে ব্রজদাস হয়, যেহেতু যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই ব্রজ। একমাত্র হৃদয়েই নামের স্থিতিস্থান। এই অবস্থাই শ্রীকৃষ্ণকে বুকে করা।”
[বসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে বুকের উপর রেখে নিয়েছেন। আজ আমরা বুকের ভেতরে প্রাণের গভীরে রাখব শ্রীকৃষ্ণ নাম ধরে। বুকে আর মুখে কৃষ্ণ নাম রেখে চলব সংসার যাত্রা পথে। জীবনের সব বাঁধা বিঘ্ন যাবে টুটে, পৌঁছে যাব ভবসাগরের ও কুলে গোকুলে আনন্দের নন্দালয়ে।
** -ঃ শ্রীশ্রী ঠাকুরের নামে শান্তিদান লীলা দৃষ্টান্ত ঃ-
** “নেন আপনার নাম। এই নামেই আপনারে শান্তি দিবে।”
ডাঃ সুধীর চৌধুরী আসামে লিডুতে কোলিয়ারী কোম্পানীতে চাকুরী করেন। জনমানব বিরল বনাঞ্চলে কর্ম জীবনে একঘেয়েমী তো আছেই। এটা লাঘবের জন্য তাঁরা সকলে প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে এক এক জনের বাসায় আনন্দ কীর্ত্তন, ভজন, গান, আর ভোজনের আয়োজন করার ব্যবস্থা করলেন। আজ ডাঃ বাবুর আঙ্গিনায় আয়োজন হয়েছে এ প্রীতিমিলন মেলার। ডাঃ বাবুর স্ত্রী সারাদিন অতিযত্ন সহকারে সকলের জন্য খাবার রান্না করেছেন। সন্ধ্যায় নিমন্ত্রিত অতিথিরাও সকলে এসেছেন। প্রচুর আনন্দ কীর্ত্তনের পর পরিতৃপ্তির সাথে সকলের ভোজন পর্বও শেষ হয়েছে।
ডাঃ বাবুর স্ত্রী সকলকে হাসিমুখে বিদায়ও দিয়েছেন। এরপর যার যার বাড়ীতে সকলে চলেও গেছেন। ডাঃ বাবুর স্ত্রী এবার খেতে যাবেন। তাঁর জন্য ভাতও বাড়া হয়েছে। তিনি হাতমুখ ধুতে গেছেন বাথরুমে। হঠাৎ সেখানে তিনি পা পিছলে পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সকল চিকিৎসার চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনদিন অজ্ঞান অবস্থায় থাকার পর তাঁকে আর রাখা গেল না। তিনি মারা গেলেন। এভাবে অকস্মাৎ স্ত্রীর মৃত্যুতে ডাঃ বাবু একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। এমন সুন্দরী, সুস্বাস্থের অধিকারী মানুষটা কিছু না বলেকয়ে এভাবে কেন মরে গেল? আর মরে গেলই বা কোথায়? এক ভীষণ তোলপাড় শুরু হলো তাঁর মনের মাঝে। এরপর হতে তাঁর সংসার আর ভালো লাগেনা, কাজ কর্মে মন বসে না, ছোট্ট দু’টি ছেলের প্রতিও লক্ষ্য নেই। কোম্পানী তাঁকে বিশ্রামের জন্য এক বছরের ছুটি দিলেন। ডাঃ বাবু স্থির করলেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে যাবেন। যেখানে যত সাধু সন্ন্যাসীর দেখা পাবেন সকলের কাছে মর্ম বেদনার কথা জানিয়ে তাঁর স্ত্রী কোথায় গেছেন জানতে চাইবেন। তিনি সুদীর্ঘ একবছর এ ভাবে বহু তীর্থে ঘুরলেন, বহু বহু সাধু সজ্জনকে এসব প্রশ্ন করলেন। কিন্তু তাঁর আশানুরূপ কোন সদুত্তর কোথাও পেলেন না, মনে শান্তিও এলো না। অবশেষে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি ফিরে আসছেন নিজের কর্মস্থলে। ফেরার পথে ট্রেনে বসে এসব আলাপ হচ্ছিল এক সহযাত্রীর সাথে। তিনি ডাঃবাবুকে জানালেন, শিয়ালদহের কাছে বৌবাজার ডিক্সন লেনে মতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসায় রামঠাকুর নামে একজন আছেন। আপনি ইচ্ছা করলে তাঁর সাথে দেখা করতে পারেন। ট্রেন হতে নেমে ইতস্ততঃ মনে ডাঃবাবু এলেন ঐ ঠিকানায়। মতিবাবুর ঘরে এসে তিনি দেখেন একজন গায়ে একটি কাঁথা জড়িয়ে শয্যায় বসে আলাপ করছেন। সামনে মেঝেতে কয়েকজন লোক বসে তাঁর বাণী শুনছেন। ডাঃবাবুও একটু দূরে মেঝেতে পাতানো সতরঞ্চির উপর বসে পড়লেন। তিনি মনে মনে ভাবছেন, এখানে এঁর কাছে কোন কিছু জানা যাবে বলে তো মনে হয় না। ইতিমধ্যে ঠাকুর মতিবাবুকে ডেকে বললেন, “এনার স্নানাহারের ব্যবস্থা করেন গিয়া।” ডাঃবাবু নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গরম জলে স্নানকরে আহারে বসলেন। খাবার দেখেতো তিনি অবাক। এমন অবেলায় বাটিতে বাটিতে সাজানো বিভিন্ন তরি তরকারী সহ অনেক কিছু। মতিবাবু তাঁকে বললেন, এখানে আপনার জন্য অতিরিক্ত কিছুই করা হয়নি। সকালে ঠাকুরই বলেছেন, আজ যা যা রান্না হবে তার থেকে যেন একজনের খাবার তুলে রাখা হয়। আপনি সে খাবারই পেলেন। ডাঃবাবু ভাবছেন, তাহলে আমিই কি সেই একজন? আমি আসার আগেই কেন এ ব্যবস্থা? প্রকৃত পক্ষে, অন্তর্যামী ঠাকুরই জানেন তাঁর কোন ভক্ত শ্রান্ত-ক্লান্ত, আর ক্ষুধার্ত হয়ে তাঁর কাছে আসছেন। তাই এর তৃপ্তির জন্য যা যা দরকার তা সব তিনিই যথাসময় ব্যবস্থা করে রাখেন। আমরা হয়ত বুঝতে পারি না।
এখানে আমাদের জীবনেও অনুরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। ২০০৫ সালে আমার স্ত্রীসহ কোলকাতা হতে ঠাকুরের দিল্লীর শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ মন্দির দর্শনে যেতে মনস্থ করি। স্বল্প সময়ে অন্য কোন ট্রেনের টিকেট না পেয়ে অগত্যা তুফান মেইলে রওনা হলাম। পথে সীমাহীন বিলম্ব আর বিড়ম্বনা দিয়ে পরদিন রাত ১০টায় ট্রেন পৌঁছলো দিল্লী স্টেশনে। পথে রীতিমত খাবার মিলেনি, তাই পেটে ভীষণ ক্ষুধা তার সাথে পথের ক্লান্তি তো আছেই। স্টেশন হতে বের হবার পর নীলিমার চোখে পড়ল হোটেল। প্রায় দুইদিন পর দেখলো ভাত। তাই বাঙ্গালীর প্রিয় ভাতের জন্য মন আনচান করে উঠল। আমি বললাম রাত অনেক হয়েছে, পথ ঘাট অচেনা, চল আগে ঠাকুরের আশ্রমে পৌঁছে যাই। তারপর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। অটোতে ছুটে চললাম আশ্রমের উদ্দেশ্যে। তখন রাত প্রায় ১১টা। একটু একটু শীতও পড়ছে, রাস্তায় লোকজনও কমে যাচ্ছে। এরমাঝে দিল্লীর শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণের বিশাল মন্দিরের সামনে এসে দেখি ততক্ষণে গেইট বন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরে কোন সাড়া শব্দ নেই। মনে হলো, সকলে ঘুমিয়ে পড়েছেন। অনেক ডাকা ডাকি করলাম, গেইটে আওয়াজ দিলাম কিন্তু কোন কাজই হলো না। অবশেষে এক জনের পরামর্শে গেলাম পাশের থানায়। সেখান থেকে পুলিশের লোক এসে ফোন করে তাদের জাগিয়ে তুললেন। দিল্লী পুলিশের এহেন মানবিক আচরণে আমরা মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। গেলাম ভেতরে, পরিচিত গুরু ভাইরা দেখেতো অবাক। এত রাতে তারাই বা কি করেন। একজন বললেন, ‘দাদা, আপনারা ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত, অন্তত চারটা ভাতেভাত রান্নাকরে হলেও তো দিতে হয়।’ নিতান্ত সৌজন্যের খাতিরে আমি বললাম, না দাদা কোন দরকার নেই, আগে একটু থাকার ব্যবস্থা করেন। আমাদের সাথে সামান্য যা আছে তা খেয়ে নেব। এর মাঝে অন্য একজন বললেন,‘দাদা আজ সন্ধ্যায় আমরা দু’জন বাইরে গেছিলাম। সেখানে খেয়ে এসেছি। আমাদের দু’জনের খাবারটা রয়ে গেছে। যদি কিছু মনে না করেন,সে গুলো আপনাদের দিতে পারি।’ আমরা সানন্দ চিত্তে সম্মতি দিলাম। তাঁরা প্রসাদ এনে দিলেন। পর্যাপ্ত, অতি সুস্বাদু প্রসাদ। আমরা এত রাতে প্রাণভরে তা আস্বাদন করলাম আর মনে মনে ভাবলাম, অতি ক্ষুধার্ত দুইজনের জন্য যেন ঠাকুরই কেবল দুজনের পরিমাণ প্রসাদ রাখার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রাখলেন। সেদিন ঠাকুরের অপার দয়ার কথা ভেবে আমরা আপ্লুত ও অবাক হয়ে গেলাম।
আজ ডাঃবাবুও অবাক হয়ে গেছেন। ব্যপারটা আসলে কি? আমার জন্যই কি এসব রাখা হলো? তিনি কি জানতেন, আমি ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে ফিরে আসছি? তা নাহলে, এসব ব্যবস্থা করে রাখলেন কেন? চিন্তিত মনে আহার শেষে তিনি আবার ঠাকুরের কাছে এলেন। অন্যরাও এর মাঝে চলে গেছেন। ঠাকুর ডাঃবাবুকে অতি স্নেহাদরে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, “এই নেন আপনার নাম। এ নামেই আপনেরে শান্তি দিবে।” ডাঃ বাবুর মনে এবারও বিরক্তি আর দ্বিধা, ‘আমি তো এখানে মন্ত্র নিয়ে শিষ্য হতে আসিনি।’ তবে তিনি আমার মনে অশান্তি আছে সে কথা জানলেন বা কি করে? ডাঃবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘তা হলে আমার মনে কি অশান্তি’? ঠাকুর মৃদুহেসে বললেন, “একটু আগে আপনার স্ত্রী এসে বলে গেলেন আপনারে আমি যেন একটু সান্ত্বনা দিই।”
ইনি বলেন কি? ‘সে তো এক বছর আগেই মরে গেছে।’ সবিস্ময়ে ডাঃবাবু জিজ্ঞেস করলেন,‘ তা হলে, বলুন তো তিনি দেখতে কেমন?’ ঠাকুর বললেন, ‘ক্যান, হালকা পাতলা চেহারা, চুল গুলি কোঁকড়ানো, আর কপালে চুলের নীচে একটা কালো জডুল আছে না?” ডাঃবাবু তো ভাবতেই পারছেন না, তিনি যে হুবহু সব বলেই দিচ্ছেন। অথচ তিনি তো এর আগে কখনও ওকে দেখেন নি। ডাঃ বাবুর অন্তর হতে দ্বিধার আবরণ ধীরে ধীরে সরে গেল। ‘তা হলে মরে গেলেও সবকিছু তো শেষ হয়ে যায় নি’! ‘আজও সে আমার শান্তি কামনা করে! আজও সে আমার সুখ-দুঃখ প্রত্যক্ষ অবলোকন করে ! তা হলে মরে গেলেও আত্মার সম্পর্ক থেকেই যায়?’ দয়ানিধি ঠাকুর এবার মধুর মধুর ভাবাবেশে ডাঃ বাবুর প্রাণে নাম সুধার পরশ দিলেন। ডাঃবাবুও নির্দ্বিধায় প্রশান্ত মনে নামাশ্রয় নিলেন। মহানামের পরশে মিটেগেল তাঁর অন্তরের জ্বালা, চলে গেল মনের সব অশান্তি। এবার তিনি স্থির করলেন কর্ম স্থলে চলে যাবেন। তিনি চলেও গেলেন। ডাঃবাবু পরে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমার কতো দুর্ভাগ্য, প্রথম দর্শনে এ দয়াল ঠাকুরকে আমি একটু প্রণাম করতেও পারিনি ।’


নামসুধা পরশে অন্তরের জমানো যত বিরহের আগুন নিভে যায়, মনের সকল গ্লানি দূর হয়ে যায়। নামেই সর্ব শান্তি, প্রশান্তি মিলে -এটুকু বুঝলেন সকলে। তাই সকলকে নামাশ্রয় পেতেই হয়। শ্রীমন্‌মহাপ্রভু বলেন, “আশ্রয় লইয়া ভজে, তারে কৃষ্ণ নাহি ত্যাজে।”
শ্রী শ্রী ঠাকুরের নাম প্রসাদ,
সরল প্রাণে বিশ্বাস করুন, নাম আর ভগবান এক। ভগবানই নাম হইয়া ভক্ত হৃদয়ে বাস করেন। সরল প্রাণে বিশ্বাস করুন, নাম আর ভগবান এক। ভগবানই নাম হইয়া ভক্ত হৃদয়ে বাস করেন। Reviewed by srisriramthakurfbpage on September 12, 2023 Rating: 5

No comments:

শ্রী শ্রী রামঠাকুরেরস্বহস্ত লিখিত পত্রাংশ -দ্বিতীয় খন্ড-223

Powered by Blogger.