"গুরুর শক্তি ও বিনয় | শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বাণী"
কেবল দিবানিশি ভগবানের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া সংসারের উপস্থিত মতে কার্য্য করিয়া যাইতে চেষ্টা করুন। পরিবারকে ঘৃণা করিতে নাই। সকলি গুরুর শক্তি। গুরুর ইচ্ছায়ই সকল সংযোগ হইতেছে। অহংকারের দ্বারা অভিমানী হইয়া আমার স্ত্রী, আমার পুত্র, আমার ধন, আমার শরীর জ্ঞান করিয়া জীব কর্ম্মপাশে বদ্ধ হয়।
স্বদেহমিন্দ্রিয় ভার্য্যা অর্থ স্বজন বান্ধবাঃ।
পিতা মাতা কুলং দেবি গুরুরেব ন সংশয়ঃ॥,'
এই শ্লোকটিতেই বুঝিতে পারেন যে আমার জ্ঞানই মিথ্যা, ভগবৎ জ্ঞানই সত্য। সকলি গুরুর, যদি আমারই আমি না হই তবে আমার কি হইবে ? সকলি ভ্রান্তি।”
শ্রী শ্রী রামঠাকুর
বেদবাণী ৩/(১৫২)
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী ৩/(১৫২) এর শ্লোকটি আধ্যাত্মিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ব্যাখ্যা করে—এটি আমাদের অহংকার, আত্মপরিচয় এবং গুরুর গুরুত্বের উপর গভীর দৃষ্টিপাত রাখে। এখানে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সব সময় ভগবান বা গুরুর দিকে লক্ষ্য রেখে জীবনের কাজকর্ম সম্পাদন করতে চেষ্টা করেন, তার জীবন হবে সার্থক এবং শান্তিপূর্ণ। আসুন, এই শ্লোকটির পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করি।
1. "কেবল দিবানিশি ভগবানের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া সংসারের উপস্থিত মতে কার্য্য করিয়া যাইতে চেষ্টা করুন।"
শ্রী শ্রী রামঠাকুর এখানে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, আমাদের সমস্ত কাজ, চিন্তা, এবং জীবনযাপন should be centered around ভগবান বা গুরুর ইচ্ছা। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কাজকর্ম সব সময় ভগবানের দিকে নিবদ্ধ রাখতে হবে, অর্থাৎ, যে কোনও কাজই যদি আমরা ভগবানের জন্য করি, তবে সেটা আমাদের জন্য একটি পূণ্যের কাজ হয়ে উঠবে।
এখানে "দিবানিশি" বা দিন-রাতের কথা বলা হচ্ছে, যাতে বোঝানো হচ্ছে যে, আমাদের মন বা দৃষ্টি কখনও ভগবানের থেকে সরানো যাবে না। জীবনের সব কাজ এবং সম্পর্ককে ঐশ্বরিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে।
2. "পরিবারকে ঘৃণা করিতে নাই। সকলি গুরুর শক্তি। গুরুর ইচ্ছায়ই সকল সংযোগ হইতেছে।"
এখানে শ্রী শ্রী রামঠাকুর স্পষ্টভাবে বলছেন যে, আমাদের পরিবারের প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞা প্রদর্শন করা উচিত নয়। সকল কিছুই গুরুর শক্তির মাধ্যমে ঘটে—আমাদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সবাই একত্রিত হয় গুরুর ইচ্ছায়।
এই মন্তব্যটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, আমাদের জীবনের সমস্ত সম্পর্ক, পরিবার বা বন্ধু-বান্ধব, সবই গুরুর আশীর্বাদ এবং ইচ্ছার ফল। যেহেতু গুরুর শক্তির মাধ্যমে সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে, আমাদের অহংকার বা রাগ-অভিমান প্রকাশ করা উচিত নয়।
3. "অহংকারের দ্বারা অভিমানী হইয়া আমার স্ত্রী, আমার পুত্র, আমার ধন, আমার শরীর জ্ঞান করিয়া জীব কর্ম্মপাশে বদ্ধ হয়।"
এই অংশটি আমাদের অহংকার এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতি একটি সতর্কবাণী। শ্রী শ্রী রামঠাকুর এখানে বলেছেন, যে ব্যক্তি অহংকারের কারণে নিজের স্ত্রী, পুত্র, ধন-দৌলত, শরীর—এইসব কিছুই নিজের বলে মনে করে, সে জীবনের সত্যিকার উদ্দেশ্য থেকে দূরে চলে যায়।
আমরা যেভাবে আত্মপরিচয় তৈরি করি এবং পৃথিবীতে নিজেদের কর্তৃত্ব দাবি করি, তা আমাদের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে। এখানে "অহংকার" বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই মনোভাব, যা আমাদের সমস্ত কিছু নিজের বলে মনে করতে বাধ্য করে এবং আমরা ভুলে যাই যে সব কিছুই গুরুর অনুগ্রহে ঘটে।
4. "স্বদেহমিন্দ্রিয় ভার্য্যা অর্থ স্বজন বান্ধবাঃ। পিতা মাতা কুলং দেবি গুরুরেব ন সংশয়ঃ॥"
এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে শ্রী শ্রী রামঠাকুর আরও স্পষ্টভাবে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, স্বদেহ (নিজের শরীর), মস্তিষ্ক (মন), ইন্দ্রিয় (আঙুল, চোখ, কান), স্ত্রী, পুত্র, বন্ধু—সবই গুরুর শক্তি।
এছাড়াও, তিনি বলেন, পিতা, মাতা, কুল, দেবী—এই সব সম্পর্ক গুরুর ইচ্ছায়ই ঘটছে, কোনো সন্দেহ নেই। অর্থাৎ, আমাদের মায়া এবং গর্বের সকল সম্পর্ক আসলে গুরুরই এক বিশেষ শক্তি। গুরুর নির্দেশে আমাদের সকল সম্পর্ক এবং জীবনব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
এখানে শ্রী শ্রী রামঠাকুর মানবজীবনের ভ্রান্তি বা মায়ার প্রতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করছেন, যা বুঝায় যে, যদি আমরা নিজেদের না জানি, যদি আমাদের আত্মপরিচয় গুরুর সঙ্গে সংযুক্ত না হয়, তবে আমাদের সমস্ত কিছু ভ্রান্তি হয়ে যাবে।
5. "এই শ্লোকটিতেই বুঝিতে পারেন যে আমার জ্ঞানই মিথ্যা, ভগবৎ জ্ঞানই সত্য। সকলি গুরুর, যদি আমারই আমি না হই তবে আমার কি হইবে ? সকলি ভ্রান্তি।”
এখানে শ্রী শ্রী রামঠাকুর সাফ বলে দিচ্ছেন, যে কোন ধরনের অহংকার, আত্মবিশ্বাস, বা আত্মপরিচয় সম্পূর্ণ মিথ্যা, কারণ আমাদের প্রকৃত পরিচয় কেবল গুরুর কাছেই। গুরুরই জ্ঞান, গুরুরই শক্তি, এবং গুরুরই ইচ্ছায় আমাদের সমস্ত কিছু ঘটে।
তিনি আরও বলেন, "যদি আমারই আমি না হই", অর্থাৎ, যদি আমি মনে করি যে, আমি নিজেই আমার সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছি বা আমি সবকিছু জানি, তবে সেটাই মিথ্যা। প্রকৃত জ্ঞান আসে গুরুর কাছ থেকেই, আর এই সত্য উপলব্ধি না করলে সব কিছুই ভ্রান্তি হবে।
উপসংহার:
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের এই বাণী আমাদের শেখায়, অহংকার ত্যাগ করে গুরুর নির্দেশে জীবনযাপন করা। আমাদের সকল কিছু, পরিবার, সম্পর্ক, ধন, শরীর, ইত্যাদি—গুরুর দয়া এবং শক্তির মাধ্যমে ঘটে। আমাদের কাজ হলো, এই সত্য উপলব্ধি করে জীবনযাপন করা, এবং সর্বদা গুরুর নির্দেশনা মেনে চলা। অহংকার, মায়া এবং নিজের ‘আমি’ ভাবনা থেকে মুক্তি পেয়ে যখন আমরা গুরুর শরণাগত হই, তখনই আমরা সত্যিকারের শান্তি এবং আত্মসিদ্ধি লাভ করতে পারি।
No comments:
Post a Comment