ঠাকুরমহাশয় একটু হেসে ঐ ভদ্রলোককে বললেন, এবার কী হাতটা একটু খাট করতে পারবেন? উত্তরে ভদ্রলোকটি জানালেন, ঠাকুরমহাশয়ের কোন আদেশই তিনি পালন করতে পারেননি, সুতরাং এটাও বোধ হয় পারবেন না।আর হাত খাট করতে যাবেনই বা কী জন্য? থাকলে ঠাকুরমহাশয়ই খাওয়াবেন, না থাকলেও তিনি।

 ★★সুদিনে ও দুর্দিনে জনৈক আশ্রিত★★

জীবন ভাগ্যের জোয়ার ভাঁটায় সংসার-রথ বহুবার টানাটানি করেছেন ঠাকুরমহাশয়ের জনৈক আশ্রিত। উপার্জ্জন ছিল তার প্রচুর,ব্যয় করেছেন বিস্তর।আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য অনেক সময় তিনি রক্ষা করতে পারেন নি,সে জন্যই মাঝে মাঝে নিদারুণ অর্থকৃচ্ছতায় ভুগতেন। ছোট হাতে কোন কিছু করা তার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না।বাড়িতে অতিথি বা আত্মীয় এলে,তিনি দশটি টাকা ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বলতেন,দ্বারিক ঘোষের দোকান থেকে দশটাকার রসগোল্লা নিয়ে এসো।

এ সময় এক টাকায় বত্রিশটি রসগোল্লা পাওয়া যেত,সঙ্গে দিত একটা ফাও।বড় মাটির হাঁড়িতে ৩৩০টা রসগোল্লা তার সামনে ড্রাইভার এনে রাখত।তিনি হাত ডুবিয়ে মুঠো মুঠো রসগোল্লা তুলে একটি থালায় রেখে অতিথির আপ্যায়ন করতেন। পরে বাড়ির সকলকে আবার মুঠো মুঠো রসগোল্লা তুলে দিতেন।পরিশেষে তিনি নিজেও হাঁড়ি থেকে তুলে রসগোল্লার সদ্ব্যবহার করতেন।
সে সময়ে দুর্গোৎসবে চারদিন ঢাক বাজাবার জন্য দশ টাকায় ঢাকী পাওয়া যেত। ২৫ টাকার ঢাকী,সে তো খুবই প্রসিদ্ধ ছিল।আশ্রিত ভদ্রলোক সাগ্রহে শারদ-অর্চনা করতেন। ঢাকা থেকে ঢাকী আনালেন। পারিশ্রমিক দিয়ে দিলেন ৫০০মুদ্রা। তার গৃহে সে বছর শারদ্যোৎসবে যে প্রভূত জনসমাগম হয়েছিল,তাহা প্রতিমা দর্শনের জন্য ততটা নয় যতটা হয়েছিল ঢাকের বাজনা শোনার জন্য।
অমিতব্যয়ী ছিলেন তিনি,কিন্তু জীবনে কোন নেশার বশে কোনদিন তিনি আসেননি। খেয়েছেন, খাইয়েছেন প্রচুর, উদারহস্তে সাহায্য করেছেন দুস্থ আত্মীয়স্বজনকে ও বন্ধুবান্ধবকে।
আশ্রিত ভদ্রলোকের নবনির্মিত প্রাসাদতুল্য অট্টালিকায় ঠাকুরমহাশয়ের শুভ পদার্পণ হয়েছে। জীবনের পরমলগ্ন উপস্থিত। যথাযোগ্য মর্য্যাদার সঙ্গে ঠাকুরমহাশয়ের উপস্থিতি সার্থক করে তুলতে তিনি সকল রকম প্রচেষ্টা করেছিলেন। যে কয়দিন ঠাকুরমহাশয় তার গৃহে অবস্থান করবেন, সে কয়দিন প্রতিদিন তিনি সহস্র মুদ্রা ব্যয় করার সঙ্কল্প নিলেন।
অর্ধশতাব্দীর কিছু আগের এই ঘটনা। তখন কলকাতা শহরে ঠাকুরমহাশয়ের আশ্রিত ও অনুরক্তের সংখ্যা খুব একটা বেশি ছিল না। ভোগ্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যও তখন অত্যন্ত সুলভ ছিল।সেই সময় প্রতিদিন সহস্র মুদ্রা ব্যয়ে ঠাকুরমহাশয়ের যে ভোগ-রাগের তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন সে আয়োজন সত্যই অসামান্য ছিল। অথচ ঠাকুরমহাশয় স্বয়ং গ্রহণ করবেন একখানি লুচির এক চতুর্থাংশের একাংশ।অথবা দু'চামচ দুধ বা বেদানার কয়েকটি দানা মাত্র।
ভদ্রলোক সেদিকে দৃকপাত করলেন না, বললেন, ঠাকুরমহাশয়ের ভোগ তো হয়ে যাক,তারপর যার ভাগ্যে আছে সেই প্রসাদ পাবে।রজক এসেছে মলিন বস্ত্রাদি নিয়ে যেতে।তিনি তাকে বললেন, তুই তো সারা বছর আমাদের জামা কাপড় সাফ করিস,ওপরে গিয়ে পেট ভরে প্রসাদ পা,তোর মনের ময়লা সব কেটে যাবে।প্রসাদ পেয়ে বাড়ির আর সবাইকে পাঠিয়ে দিস,তারাও পেট ভরে প্রসাদ পাবে।
তিন দিন ঐ গৃহে অবস্থানের পর ঠাকুরমহাশয় চতুর্থ দিনে সকালবেলা বাড়ির সকলের কাছে বিদায় নিলেন। সিঁড়ির ধাপ শেষ হতে আর কয়েকটা বাকি ছিল,এমন সময়ে গৃহস্বামী এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ঠাকুরমহাশয় কোথায় যাচ্ছেন।? আর দু'দিন যদি থাকতেন, আরও আনন্দ হতো। ঠাকুরমহাশয় জানালেন যে তিনি কপর্দকশূন্য দরিদ্র একজন ব্রাহ্মণ মাত্র। তাহার জন্য প্রতিদিন ঐ ভদ্রলোক এক হাজার টাকা ব্যয় করছেন।তিনি আরও বেশীদিন থাকলে তার আরও কয়েক সহস্র টাকা ব্যয় হবে।সুতরাং তিনি তো আর থাকতে পারে না। কাতর হয়ে ভদ্রলোক বললেন, জীবনে সদ্ব্যয়ের সুযোগ তো পাওয়া যায় না। টাকা আসে,টাকা যায় কিন্তু সৎকার্যে ব্যয় করার সময় বা সুযোগ কোনটাই হয় না।ঠাকুরমহাশয় ততক্ষণে তার বাড়ির সীমানা অতিক্রম করে গিয়েছেন।
কালের কুটিল গতির আবর্তে পড়লেন ঐ আশ্রিত ব্যক্তি। সপরিবারে নিজগৃহ ছেড়ে দুঃস্থ-লোক অধ্যুষিত পল্লীতে একটি পুরাতন জীর্ণ বাড়ির একাংশে স্বল্প ভাড়ায় উঠে আসতে বাধ্য হলেন। অতি ক্লেশে দিন কাটছিল পরিবারের সকলের,এমনকি গ্রাসাচ্ছাদনেও টানাটানি চলছিল। কিন্তু আশ্রিত ভদ্রলোক ছিলেন অনমনীয়। কোন অবস্থাতেই তার উন্নতশির অবনত করেনি,একমাত্র ঠাকুরমহাশয়ের পদপল্লবে ছাড়া।ভাগ্যচক্রের এই দুর্যোগ দুর্বিপাকে ধৈর্য্য তিনি হারাননি, তাকে হাহুতাশ করতেও কেউ শোনেননি।
একদিন রাত দশটা নাগাদ তিনি একটু বিশেষ প্রয়োজনে বাড়ির বাহিরে গেলেন।জনবিরল সেই পথে পিচ তখনো পড়েনি।গ্যাসের স্নিগ্ধ আলো অনেকটা দূরে দূরে। সেই মৃদু আলোকে ভদ্রলোক দেখলেন, ঠাকুরমহাশয় তার বাসস্থানের সামনে পদচারণা করছেন। রাস্তার উপরেই ঠাকুরমহাশয়ের দু'চরণে লুটিয়ে পড়লেন ঐ ভদ্রলোক। উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, এত রাত্রে এই পথে ঠাকুরমহাশয়? বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন, হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে পৌঁছেছেন,উত্তরে জানালেন ঠাকুরমহাশয়।
একদিন ঠাকুরমহাশয় শ্রীঅনন্ত চক্রবর্তীর কালীঘাটের বাসা থেকে রুগ্ন দেহে প্রাতঃভ্রমণে বাহির হয়ে গড়ের মাঠে এসে পৌঁছলেন। পরে ইডেন গার্ডেনে গিয়ে কয়েকটা গাঁদাল পাতা খেলেন রোগ উপশমের জন্য।সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে পৌঁছলেন। হাওড়া স্টেশনে তাঁহার পরিচিত জনৈক রেল কর্মচারী তাঁহার অভিপ্রায় অনুযায়ী হরিদ্বার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।যিনি একদা প্রাতঃভ্রমণে বাহির হয়ে হরিদ্বার গিয়ে পৌঁছেছিলেন।তাঁহার পক্ষে বৈকালিক ভ্রমণ রাত দশটাতেও যে শেষ হয় না তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে।
সাগ্রহে এবং সমাদরের সঙ্গে আশ্রিত ভদ্রলোকটি নিজ বাসগৃহে নিয়ে গেলেন ঠাকুরমহাশয়কে! ঠাকুরমহাশয় একখানা চেয়ারে বসলেন। পুরাতন বাড়ির মেঝে অত্যন্ত স্যাঁতসেতে।ঠাকুরমহাশয়ের চরণযুগল যাতে সিক্ত হয়ে না ওঠে এজন্য ঐ ভদ্রলোক একখানা বস্তা পেতে দিলেন তাঁহার দু'চরণের তলে।বস্তাটি ক্রমশঃ সিক্ত হয়ে উঠতে লাগল।
আশ্রিত ভদ্রলোক তাঁহাকে তার অবস্থা বৈগুণ্যের কথা সবিস্তারে খুলে বললেন। ঠাকুরমহাশয়ের অনেক বিত্তবান ভক্ত রয়েছেন। ঠাকুরমহাশয় বললে তারা এই দুঃসময়ে নিশ্চয়ই কিছু ঋণ দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারেন এবং তিনিও কয়েকমাসের মধ্যে তার প্রাপ্য টাকা পেলে তাদের দেনা শোধ করে দিতে পারবেন। "আমাকে যারা স্নেহ করতেন বা আমার কথা কিছুটা রক্ষা করতে চেষ্টা করতেন,সেই দু'পাঁচজনের কেহই আর এখন ইহ জগতে নাই," বললেন ঠাকুরমহাশয়। "এই যে হাজার হাজার ভক্ত আপনার কলকাতায় দেখি," বললেন আশ্রিত ভদ্রলোক।মৃদু মধুর হাসির সঙ্গে উত্তর করলেন ঠাকুরমহাশয়, "এনারা ভক্ত নন,শক্ত"।
যাওয়ার সময়ে ঠাকুরমহাশয় সমগ্র পরিবারটিকে আশ্বস্ত করে বলে গিয়েছিলেন যে অনাহারে তারা মরবেন না।প্রতিদিন কিছু না কিছু পাঠিয়ে দেবেন।সমভাবে বন্টন করে তা খেলে দেহ সুস্থই থাকবে।এই দুর্দিনের ঘনঘটা কয়েকদিনের মাত্র।পরদিন থেকে প্রতিদিন ঠাকুরমহাশয় কিছু ফল বা মিষ্টি কাহারও মারফৎ তাদের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। বড় পরিবারের সকলে তা' ভাগ করে খেতেন।
এ সামান্যই অসামান্য হয়েছিল তাদের নিদারুণ দুর্দিনে।সামান্য ফল বা মিষ্টি খেয়ে সকলের দিনরাত কাটত।ক্ষুধার তীব্রতা কেহ অনুভব করেননি বা অল্পাহার জনিত দৈহিক দৌর্বল্য কারও দেখা দেয় নি। পরিবর্তনশীল পৃথিবী, সুখদুঃখ কোনটাই চিরস্থায়ী নহে।ভাগ্যচক্র আশ্রিত ভদ্রলোকের অনুকূলে আবর্তিত হল।আর দুঃখ নিশার অবসান হল। প্রাপ্য টাকার কিয়দংশ তার হাতে এল।কলকাতার যে বাড়িতে ঠাকুরমহাশয় তখন ছিলেন, প্রচুর ফল মিষ্টি নিয়ে ঐ ভদ্রলোক সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করে তিনি কিছু ভোগ গ্রহণ করার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ জানালেন। সামান্য একটু ভোগ্যবস্তু মুখে তুলে দিতে দিতে ঠাকুরমহাশয় বললেন, যে তিনি তার প্রাপ্য টাকার কিছুটা পেয়েছেন মাত্র।এত ভোগ্য সামগ্রী কেন এনেছেন? অল্প হলেই তো হতো। সে কথায় কান না দিয়ে ভদ্রলোক মুঠো মুঠো করে ঠাকুরমহাশয়ের প্রসাদ উপস্থিত সকলের মধ্যে বিতরণ করলেন এবং ঠাকুরমহাশয়কে অনুরোধ করলেন যেন সেদিন থেকে তাদের জন্য আহার্য্য না পাঠান।
ঠাকুরমহাশয় একটু হেসে ঐ ভদ্রলোককে বললেন, এবার কী হাতটা একটু খাট করতে পারবেন? উত্তরে ভদ্রলোকটি জানালেন, ঠাকুরমহাশয়ের কোন আদেশই তিনি পালন করতে পারেননি, সুতরাং এটাও বোধ হয় পারবেন না।আর হাত খাট করতে যাবেনই বা কী জন্য? থাকলে ঠাকুরমহাশয়ই খাওয়াবেন, না থাকলেও তিনি।
জয় রাম জয় গোবিন্দ
ঠাকুরমহাশয় একটু হেসে ঐ ভদ্রলোককে বললেন, এবার কী হাতটা একটু খাট করতে পারবেন? উত্তরে ভদ্রলোকটি জানালেন, ঠাকুরমহাশয়ের কোন আদেশই তিনি পালন করতে পারেননি, সুতরাং এটাও বোধ হয় পারবেন না।আর হাত খাট করতে যাবেনই বা কী জন্য? থাকলে ঠাকুরমহাশয়ই খাওয়াবেন, না থাকলেও তিনি। ঠাকুরমহাশয় একটু হেসে ঐ ভদ্রলোককে বললেন, এবার কী হাতটা একটু খাট করতে পারবেন? উত্তরে ভদ্রলোকটি জানালেন, ঠাকুরমহাশয়ের কোন আদেশই তিনি পালন করতে পারেননি, সুতরাং এটাও বোধ হয় পারবেন না।আর হাত খাট করতে যাবেনই বা কী জন্য?  থাকলে ঠাকুরমহাশয়ই খাওয়াবেন, না থাকলেও তিনি। Reviewed by srisriramthakurfbpage on April 02, 2024 Rating: 5

No comments:

শ্রী শ্রী রামঠাকুরেরস্বহস্ত লিখিত পত্রাংশ -দ্বিতীয় খন্ড-223

Powered by Blogger.