রাম ঠাকুরের কথা 🌹
রাম ঠাকুরের কথা 🌹
একদিন ভোর বেলায় গড়ের মাঠে বেড়াইতে গিয়া প্রভূত বিত্তশালী একজন অতি ধনাঢ্য ব্যক্তির সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। আমি তাহাকে এড়াইতেই চাহিয়াছিলাম কিন্তু তিনি দূর হইতেই আমাকে দেখিয়া তাহার নিকটে ডাকিলেন, সুতরাং আমাকে যাইতেই হইল। তিনি বলিলেন: “অনেক দিন পরে দেখা, কেমন আছেন, মাষ্টার মশাই?” আমি বলিলাম যে ভালই আছি, সম্প্রতি লেক-মার্কেটের নিকটে ছোট্ট একখানি বাড়ী করিয়াছি এবং সেইখানেই বসবাস করিতেছি। তিনি কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করিতেই আরম্ভ হইল অভাব অভিযোগের এক প্রকাণ্ড ফিরিস্তি। প্রায় আধঘণ্টা ধরিয়া তিনি আমাকে কোথায় কোন সম্পত্তি নষ্ট হইতে চলিয়াছে, কোথায় কত টাকা অযথা আটক পড়িয়া আছে, কোন্ কর্মচারী কি করিয়াছে ইত্যাদি নানা কথা এক নিঃশ্বাসে বলিয়া গেলেন। আমার মনে হইল যে এই ভদ্রলোক যেন আমার চেয়ে অনেক বেশী দরিদ্র, এত অভাব-বোধ তো আমার নাই। সঙ্গে সঙ্গে ইহাও মনে হইল যে অভাব নহে, অভাব-বোধই দারিদ্র্যের লক্ষণ হওয়া উচিত। কথাটা মোটেই নূতন নহে, অনেকেই ইহা বলিয়াছেন এবং অনেকেই ইহা জানেন, কিন্তু কোন কিছু জানা এক কথা এবং অন্তর দিয়া উপলব্ধি করা অন্য কথা। সেই দিন হইতে আমার মনে এই ধারণাটা বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে যে "নাই নাই, চাই চাই” রব যাহার মধ্যে যত বেশী সে তত দরিদ্র এবং যাহার মধ্যে যত কম, সে সেই পরিমাণে ধনী। সাংসারিক অবস্থার সহিত ইহার বিশেষ কোনও সম্পর্ক নাই। সেইজন্যই যখন কোন পদস্থ ও স্বচ্ছল ব্যক্তিকে সামান্য ১০/১২ টাকা লোকসানের আতঙ্কে চঞ্চল হইতে দেখিয়াছি, তখনই মনে হইয়াছে, আহা, লোকটা কি দরিদ্র! মানুষের কাঙ্গালপনার অন্ত নাই এবং কখন কি ভাবে যে তাহা আত্মপ্রকাশ করে, তাহাও বলিয়া শেষ করা যায় না। নানা সভা-সম্মেলনে উপস্থিত কোন বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তির সামান্য এক-আধ মিনিটের সাহচর্য্য লাভের প্রত্যাশায় কত চতুরতা, কত সতর্কতা ও কত অধ্যবসায়ই না অপব্যয়িত হইতে দেখিয়াছি। কিন্তু যাক্, এই প্রসঙ্গ আর বাড়াইয়া লাভ নাই। বলিতেছিলাম যে ধৰ্ম্ম ধরিয়া থাকিলে সকল দিক বজায় থাকে, এই কথাটার বিচার শুধু বাহ্যিক অবস্থার মাপকাঠিতে চলে না। "লেগে থাকলে মেগে খায় না", ঠাকুরের এই কথাটিও একটু বিচার করিয়া বুঝিয়া লওয়া প্রয়োজন। তিনি শুধু এইটুকুই বলিলেন যে তাঁহাকে লইয়া থাকিলে মাগিয়া খাইতে হয় না। ধনজনবৈভবাদির কথা তিনি কিছুই বলিলেন না, কেবল এই আশ্বাসই দিলেন যে সংসার কখনও অচল হইবে না। কিন্তু "লেগে থাকা” বলিতে কি বুঝিতে হইবে? ঠাকুর সে যাত্রায় আমার বাড়ী হইতে চলিয়া যাইবার পূর্ব্বের দিন রাত্রে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া কথাটা খানিকটা পরিষ্কার করিয়া লইয়াছিলাম। খাওয়া দাওয়ার পর ঠাকুরের নিকটে বসিয়াছিলাম, আর কেহই সেখানে ছিল না। কি কথাবার্তা হইতেছিল স্মরণ নাই, হঠাৎ এক সময় আমি ঠাকুরকে বলিলাম: "আমি নিতান্ত নির্বোধ, আমার মতিগতির কোন ঠিক্-ঠিকানা নাই। আজ আপনাকে ভাল লাগিয়াছে, আপনার নিকটে বসিয়া সাগ্রহে আপনার উপদেশ শুনিতেছি, কালই হয়তো রাস্তায় দাঁড়াইয়া আপনাকে ভণ্ড, মিথ্যাচারী বলিয়া চিৎকার করিতে থাকিব। আমার আত্মবিশ্বাস মোটেই নাই। আপনাকে যদি ছাড়িয়াই দেই তখন আমার কি উপায় হইবে?” ঠাকুর উত্তরে বলিলেন: "আপনে ছাড়তে পারেন, কিন্তু সে তো ছাড়বে না।” আমি আনন্দে হতবাক্ হইয়া গেলাম, কি আশ্চয্য করুণা, কি জীবন্ত আশ্বাস! তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিলেও তিনি পরিত্যাগ করিবেন না। সত্যইতো, আমি চিন্তা করিয়া মরি কেন? আমি আসিতে চাহি নাই, তিনিই আমাকে কাছে টানিয়া লইয়াছেন, রাখিতে হয় রাখিবেন, মারিতে হয় মারিবেন। ঠাকুর বলিতেন যে, মর্কট বুদ্ধি ভাল নয়, মার্জার বুদ্ধিই ভাল। বানরের বাচ্চাগুলি নিজেরাই মা'কে ধরিয়া থাকে, সুতরাং মা যখন এক গাছ হইতে অন্য গাছে লাফাইয়া যায় তখন তাহাদের নিজের শক্তির উপরই নির্ভর করিতে হয় এবং কখন কখন পড়িয়া গিয়া মরিতেও হয়। মার্জার শিশুর কিন্তু কোন চিন্তাই নাই। সে সম্পূর্ণরূপে মা'কে নির্ভর করিয়া থাকে এবং মা যখন যেখানে রাখে নির্বিচারে সেইখানেই পড়িয়া থাকে। ক্ষুধা হইলে স্বভাবতঃই কাঁদে, মা আসিয়া আহার দিয়া যায়। ঠাকুরও আমাদিগকে নানা কথার ভিতর দিয়া এই মার্জার শিশুর মত পড়িয়া থাকিতেই নির্দেশ দিয়া গিয়াছেন কিন্তু মর্কট-বুদ্ধি যে ছাড়িয়াও ছাড়ে না। একখানি পত্রে ঠাকুর লিখিয়াছিলেন: “সর্ব্বদাই গুরুর নিকট থাকিতে লালসা রাখিয়া, তাহারই নিকটে তাহারই বাঞ্ছিত অবস্থায়, তাহারই কোলে ছোট ছেলেটির মত সর্ব্বদা বসিয়া আছেন এরূপ কল্পনা করিতে চেষ্টা করিবেন। তাহার রক্ষিত জনের ভয় কি?" (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ৮৬নং) ইহাও এক প্রকার মার্জার শিশুর অবস্থা। ঠাকুর রহিয়াছেন, সুতরাং আমার আর ভাবনার কিছুই নাই, এই চিন্তার অনুশীলনই "লেগে থাকা"। শ্রীশ্রী রাম ঠাকুর। লেখক: ডক্টর শ্রী ইন্দুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। -----------------------------------
রাম ঠাকুরের কথা 🌹
Reviewed by srisriramthakurfbpage
on
June 04, 2024
Rating: 5
No comments: