-ঃস্বর্গীয় মথুরামোহন মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তীর ট্রেনে ঠাকুরের দর্শনলাভঃ-
প্রায় সত্তর বছর আগেকার কথা।
এলাহাবাদ চলেছিলেন "ঢাকা-শক্তি-ঔষধালয়ে" র প্রতিষ্ঠাতা ও সত্ত্বাধিকারী স্বর্গীয় মথুরামোহন মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী মহাশয়। ট্রেন তখন ছাড়ার সামান্যই বাকি। গার্ডের সবুজ সঙ্কেত দেখে তিনি দ্রুতচরণে তার জন্য নির্দিষ্ট সেকেন্ড ক্লাস কামরায় উঠে পড়লেন। ট্রেন ছেড়ে দিল। উঠবার সময় অনতিদূরে প্রথম শ্রেণীর এক কামরার সামনে প্ল্যাটফর্মে বহু নর-নারীর ভিড় তার দৃষ্টি এড়ায়নি। নিজের নির্দিষ্ট আসনে বসে সহযাত্রীদের কাছে শুনতে পেয়েছিলেন একজন সন্ন্যাসী প্রবরের নাম।
মথুরামোহন ছিলেন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রিত। সাধুসঙ্গ তার ছিল অতিপ্রিয়। ইতিপূর্বে অনেকবার ঐ সন্ন্যাসী প্রবরের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ তিনি লাভ করেছিলেন। টাইম-টেবিলখানা তিনি দেখতে লাগলেন। ঘন্টাখানেক বাদে যে স্টেশনে এসে গাড়ি থামল, সেখানে গাড়ি থামবে অনেকক্ষণ। তার হাতেও সময় থাকবে তখন এই কামরা থেকে সন্ন্যাসী প্রবরের কামরায় পৌঁছুবার।
কিছু নরনারীও এ মাঘের দুর্জয় শীত উপেক্ষা করে সন্ন্যাসী-প্রবরকে প্রণাম করতে এসেছিলেন এবং প্রণামান্তে তাঁর দেওয়া ফল-মিষ্টি নিয়ে প্রসন্নচিত্তে একে একে তারা সকলে নেমে গেলে মথুরামোহন সন্ন্যাসীপ্রবরের দুই চরণে আপন শির স্থাপন করে প্রাণভরে প্রণাম করলেন। সহাস্যে আশির্বাদ করলেন সন্ন্যাসীপ্রবর। ধীর-মন্থর গতিতে ট্রেন চলছিল। মথুরামোহন সন্ন্যাসীপ্রবরের সঙ্গে কথাবার্ত্তা বলছিলেন আর লাভ করছিলেন বিমল আনন্দ। ফুলফলে সুসজ্জিত প্রথম শ্রেণীর কামরাখানি। ভক্তদের দেওয়া ফুলের মালা আর ফল-মিষ্টান্নের পাহাড়। বাঁপাশে সুমধুর ভজন গান চলছিল। কামরার মধ্যে অনুরক্তরাও সংখ্যায় অনেক ছিলেন। সুতরাং মথুরামোহনের মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যে, তিনি সন্ন্যাসীপ্রবরের অনেকটা সময় নষ্ট করেছেন। উঠি উঠি অনেকবার করেছেন কিন্তু উঠতে আর পারছিলেন না। ট্রেনটি আবার চলতে আরম্ভ করলো এবং অতিদ্রুতগতিতে ট্রেনখানা চলছিল, কামরায় একটা জানালা খোলা ছিল। সেই জানালা দিয়ে ভজন গানের সুমধুর সুর ফুলের সুবাস মেখে বাতাস যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে যাচ্ছে।
বারংবার মথুরামোহনের যেন মনে হচ্ছিল এই কামরাখানা স্বর্গের সিংহদ্বারে গিয়ে পৌঁছুবে।
একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠলেন মথুরামোহন। গাড়ি থামল পরবর্তী স্টেশনে। তিনি প্রণামান্তে ঐ কামরা ছেড়ে চলেছিলেন আচ্ছন্নের মত নিজের কামরার দিকে। খেয়াল ছিল না গাড়ি কখন মৃদু মন্থর গতিতে পুনরায় তার যাত্রা শুরু করেছে, সহসা সম্বিত ফিরে পেলেন তিনি-উদভ্রান্তের মত নিকটবর্ত্তী এক তৃতীয় শ্রেণীর কামরায়ই উঠে পড়লেন। কামরাখানা ভিড়ে ঠাসা, যাতায়াতের পথেও অনেকেই বিছানা করে শুয়ে পড়েছেন। কামরার সব দরজা জানালা বন্ধ। যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই তামাক সেবনে ধোঁয়া উড়াচ্ছেন।শৌচাগারের দরজাটির কজ্বা-ভাঙ্গা, সেই দরজা দিয়ে যেন নরকের দুর্গন্ধ ক্ষণে ক্ষণে নাকে আসছে। রুমালে নাক ঢাকলেন মথুরামোহন। অন্নপ্রাশনের অন্ন প্রায় উগরে আসছে তার। কিন্তু নিরুপায় তিনি যতক্ষণ না পরবর্তী স্টেশনে এসে গাড়ি থামছে।
এদিক ওদিক বার বার তাকাচ্ছেন তিনি অস্থির ভাবে। সহসা সুপরিচিত একখানা মুখ তার নজরে এল, সেদিকেই পা বাড়ালেন কোনও রকমে পথ করে। অতিকষ্টে এসে প্রণাম করলেন সেই পরিচিতের চরণতলে। "রামঠাকুর" মহাশয় দু'পাশে দুই স্থুলকায় মানুষের মাঝে পিষ্ট হচ্ছিলেন কষ্টের কাষ্ঠ আসনে বসে। মৃদু হাস্যে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনে, আপনে ক্যান এই কষ্টের কামরায় আইলেন?" উত্তরে মথুরামোহন সব কিছু বললেন আর বিনীতকন্ঠে আবদারের সুরে জানালেন যে পরের স্টেশনে গাড়ি থামলে তাঁকে নিয়ে যাবেন এই জীবন্ত নরক থেকে। দ্বিতীয় শ্রেণীর কোনও কামরায় যদি স্থান না থাকে তাহলে প্রথম শ্রেণীর টিকিট কিনে তাঁকে সেখানে বসাবেন।
স্নেহ-সুধা-মাখা কন্ঠে ঠাকুর বলতে লাগলেন, "কাশীতে মাঘ মাসে আসুম এই কথা একজনকে দিছিলাম। কিন্তু জানেন তো আমার অবস্থা। মাঘের আধা শেষ হইয়া গেল অথচ কাশী যাওয়ার সম্বল আমি সংগ্রহ করতে পারি নাই। অনেকেরেই বলেছিলাম, স্বল্প-বিত্তের সংসারী মানুষ তারা হয়তো পাইরা ওঠেন নাই। তাদের কোনও দোষ নাই। আইজ একজন আমারে থার্ড ক্লাসের একখানা টিকিট কাইটা দিছেন। তারই অনুগ্রহে আমি তো কাশীর দিকে আগগাইতে পারছি।" নাছোড়বান্দা মথুরামোহন। তিনি জানালেন, ঠাকুরমহাশয়ের জন্য যদি সামান্য ব্যয় করতে পারেন সেটাই হবে তার জীবনের সত্যিকারের সঞ্চয়। এই সুযোগকে তিনি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবেন না, যদি তাতে ঠাকুরমহাশয়ের কিঞ্চিত মাত্র কষ্টের লাঘব হয়। তবুও সম্মত হলেন না ঠাকুরমহাশয়। জানালেন, "হাজার হাজার যাত্রী প্রতিদিন কষ্টের মধ্যে গাড়ির থার্ড ক্লাসে যাতায়াত করেন যদিও তারা অনেকাংশেই আমার অপেক্ষা সক্ষম। সামান্য হলেও তারা উপার্জনক্ষম। " একটু হেসে ঠাকুরমহাশয় আরও জানালেন, ফোর্থ ক্লাস নাই, থাকলে ঐটার টিকিটও আমি কিনতে পারতাম না। মথুরামোহনের মনে তখন প্রচন্ড প্রলয় হচ্ছে।
অর্থের প্রাচুর্য আছে তার। সৎকার্যে ব্যয় করার প্রবৃত্তিও তার প্রবল। অথচ একান্তভাবে আপনাকে অসহায় বোধ করতে লাগলেন মথুরামোহন তখন। বুঝলেন যে সৎ ব্যয় করতে পারাও ঈশ্বরের কৃপাসাপেক্ষ। তখন মথুরামোহন ঠাকুরমহাশয়ের কাছে পুনরায় আরেকটি প্রস্তাব রাখলেন অনেকটা নিরুপায় হয়েই। ট্রেন থামলে ঠাকুরমহাশয়কে নিয়ে যাবেন তার নির্দিষ্ট সেকেন্ড-ক্লাসের আসনে আর মথুরামোহন বসবেন ঠাকুরমহাশয়ের পরিত্যক্ত আসনে। এবারেও একটু মৃদু হেসে ঠাকুরমহাশয় এই প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন এই যুক্তি দেখিয়ে ----ঠাকুরমহাশয় অত্যন্ত কৃশকায় আর তাঁর দু'পাশের দু'জনই অতি স্থুলকায়। মথুরাবাবু যদি এখানে বসেন তবে কষ্ট তিনি একাকীই পাবেন না সহযাত্রী দু'জনও এতে সমপরিমাণ ক্লেশের অংশীদার হবেন। বাকী রাতটুকু তিনি অনায়াসে এখানেই বসে কাটিয়ে দিতে পারবেন। আর কয়েক ঘন্টা বাদে তো ট্রেন কাশীতে গিয়েই থামবে। একটা কিছু করবার জন্য মথুরাবাবু নিসপিস করছিলেন। আজানুলম্বিত অলেক্টারের পকেট থেকে তিনি অবশেষে তার স্ফিতকায় মানিব্যাগটি থেকে পঞ্চাশটি টাকা বার করে সজল চক্ষে ঠাকুরমহাশয়ের হাতে গুঁজে দিলেন। ঠাকুরমহাশয় জিজ্ঞাসা করলেন, "এই টাকা ক্যান দিতে আছেন? " উত্তরে মথুরাবাবু জানালেন, "কাশী স্টেশনে নেমে তিনি যেন গাড়ি করে যে বাড়ি যাবেন সে বাড়ি যান। আর কাশীতে থাকাকালীন যাতায়াতও যেন গাড়িতেই করেন।" কাশীর মাঘের শীতেও ঠাকুরমহাশয়ের অঙ্গ ঢাকা ছিল একখানি মোটা খদ্দরের চাদরে। সটান উঠে দাঁড়ালেন। সেই চাদরখানায় আপন অঙ্গ আবৃত করে টাকাকটি আবার তুলে দিলেন মথুরাবাবুর হাতেই। তাকে বললেন, "ট্রেন থামনের সময় হইছে। এইখানে পাঁচ মিনিট গাড়ি থামবো। আপনি নিজের কামরায় গিয়া আরাম কইরা বসেন। আমার কষ্টের জীবন। আমার সংস্পর্শে যিনি আসেন তার জন্য কিছুই আমি করতে পারি না, তারা শুধু কষ্টই ভুইগ্যা যান।"
গাড়ি থামল। মথুরাবাবু পুনরায় প্রনাম সারলেন। ঠাকুরমহাশয় দরজাটি খুলে দিয়ে বললেন, "আপনি আসেন গিয়া--আবার দেখা হইবো।"
মথুরাবাবু অনেকক্ষণ বাদে এসে বসলেন আপন আসনে। ট্রেন ছেড়ে দিল। কিন্তু এখন আর আসন আরামপ্রদ বোধ হল না। মনে হ'ল কন্টক-ভরা এই আসন, বড়ই দুঃসহ। আশৈশব থেকে আমরণ জীব সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকে দুঃখ দূরীকরণের, আর সুখ সম্পদ সংগ্রহের জন্য। কিন্তু ঠাকুরমহাশয় সম্পূর্ণ অন্য পথের পথিক। সুখ-সম্পদ বা আরাম তিনি উপেক্ষা করেন----দুঃখ, দুর্দশাকে তিনি আমন্ত্রণ করে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন। সৌভাগ্যের পূর্ণ-শশীকে তিনি পশ্চাতে ফেলে দুর্যোগভরা ঘোর অমানিশায় দুর্গম বন্ধুর পথে, দৃঢ় চরণে চলেন।
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। কুয়াশা গেছে কেটে। গাড়ির গতিবেগ মন্থর হয়ে এল। মথুরামোহন জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেন। দেখা যাক, ঠাকুরমহাশয়কে প্রভাত সূর্যের আলোকে যদি আর একবার দর্শন পাওয়া যায়। সহস্রকন্ঠে বিশ্বনাথজ্বীর জয়ধ্বনিতে ঘুরে ফিরে বারে বারে স্টেশন শুধু স্টেশান মুখরিত হচ্ছে। কোলাহলের মধ্যে যাত্রীরা স্টেশান পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন, কিন্তু কৈ ঠাকুরমহাশয়কে তো তিনি পাচ্ছেন না। প্ল্যাটফরমে নেমে পড়লেন তিনি, এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। সহসা তার নজরে পড়ল ঠাকুরমহাশয় আসছেন। মথুরাবাবু ঠাকুরমহাশয়কে ছুটে গিয়ে প্রনাম করলেন।ঠাকুরমহাশয় ট্যাক থেকে সযত্নে রক্ষিত টিকিটখানা বের করলেন। আশির্বাদ ভরা দু'খানি হাত রাখলেন মথুরাবাবুর শিরে আর বললেন, "আপনি গাড়িতে বসেন গিয়া আর আমিও আসি।"
জয় রাম। জয় গোবিন্দ।।
প্রচারে কৈবল্যধাম।।
Reviewed by srisriramthakurfbpage on December 16, 2024 Rating: 5

No comments:

শ্রী শ্রী রামঠাকুরেরস্বহস্ত লিখিত পত্রাংশ -দ্বিতীয় খন্ড-223

Powered by Blogger.