আজ শ্রীশ্রী রামঠাকুরের ৭৬তম তিরোভাব তিথি। বাংলা ১৩৫৬ সালের ১৮ই বৈশাখ (ইং- ১লা মে, ১৯৪৯) অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য লগ্নে, নোয়াখালি জেলা অন্তর্গত চৌমুহনীতে ৯০ বছর বয়সে শ্রীশ্রী রামঠাকুরের তিরোধান হয়।
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের সন্ন্যাস জীবনের পূর্বের নাম ছিল রাম চন্দ্র চক্রবর্তী। বাংলা ১২৬৬ সালের ২১শে মাঘ (ইং- ১৮৬০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি), বৃহস্পতিবার, মাঘী শুক্লা দশমী তিথি ও রোহিনী নক্ষত্রে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ডিঙ্গামানিক গ্রামে শ্রীরাধামাধব চক্রবর্তী ও শ্রীমতি কমলাদেবীর অন্যতম সন্তান শ্রীশ্রী রামঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন।
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের পিতার আদি বাড়ি বর্তমানে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার পদ্মা নদীর পাড়ে প্রসিদ্ধ গ্রাম জপসাতে রয়েছে। পদ্মার কীর্তিনাশার দরুন রাধামাধব জপসা গ্রাম ছেড়ে ডিঙ্গামানিক এসে সদানন্দ চক্রবর্তীর মেয়ে কমলাদেবীকে বিবাহ করেন এবং সদানন্দের সমস্ত স্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়ে সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। শ্রীশ্রী রাম ঠাকুরেরা ছিলেন চার ভাই ও এক বোন। তারা হলেন কালীকুমার, কাশীমণি দেবী, জগবন্ধু এবং রাম ও লক্ষণ দুই যমজ ভাই।
ছেলেবেলায় গ্রামের পাঠশালায় বাংলা শেখার মাধ্যমে শ্রীশ্রী রামঠাকুরের শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। পিতা তন্ত্রসাধক ছিলেন বলে বালক বয়সেই রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ চর্চায় তিনি গভীর মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল প্রখর। দুই যমজ ভাইয়ের একই সঙ্গে উপনয়ন হয়। ত্রিসন্ধ্যাবন্দনা থেকে সব করণীয় কাজ তিনি একাগ্রতার সঙ্গে পালন করতেন।
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের পিতার গুরুদেব ছিলেন শ্রীমৃত্যুঞ্জয় ন্যায়পঞ্চানন। তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরকে খুব স্নেহ করতেন। মাত্র আট বছর বয়সে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর পিতাকে হারান। পিতার মৃত্যুর কয়েক দিন পর গুরুদেবের অসুস্থতার খবর শুনে শ্রীমতি কমলাদেবী যমজ পুত্র রাম লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে দেখতে যান। তাঁদের সামনেই গুরুদেব শ্রীমৃত্যুঞ্জয় ন্যায়পঞ্চানন মারা যান। কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রথমে পিতা, পরে গুরুদেবের মৃত্যুতে বালক রামঠাকুরের মনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মানুষের জীবনমৃত্যু কেন্দ্রিক নানা প্রশ্ন তাঁর মনে ঘুরপাক খেতে থাকে।
অল্প কিছুকাল পরে অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে স্বপ্নে দেখা দিয়ে গুরুদেব তাঁকে সিদ্ধ মন্ত্র দেন। এর পর তাঁর জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। সিদ্ধ পুরুষের মতো তিনি মাঝে মাঝেই ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়তেন। মানসিক ভাবাবিষ্ট শ্রীশ্রী রামঠাকুর ১৮৭২ সালে সকলের অজ্ঞাতে অজানাকে জানার লক্ষ্যে গৃহত্যাগী হন। অনুসন্ধিৎসু বালক পায়ে হেঁটে বন জঙ্গল পাহাড় নদীর অজানা অচেনা পথ পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছালেন আসামের শ্রীশ্রী কামাখ্যাদেবীর মন্দিরে। অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে শ্রীশ্রীকামাখ্যা মন্দিরে পৌঁছে গুরুদেবের দেওয়া সিদ্ধ নাম এক মনে জপ করার সময় তিনি পরিষ্কার শুনতে পেলেন, গম্ভীর গলায় তাঁকে কে যেন ডাকছে। রাম, রাম ডাক শুনে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হল না, যে গুরুদেবের সিদ্ধ নাম তিনি স্বপ্নে পেয়েছেন, এই ডাক হল তাঁরই। ডাকের অমোঘ টানে সাড়া দিয়ে বাইরে এসে শ্রীশ্রীঠাকুর দেখেন জটাধারী, দীর্ঘাঙ্গী এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁকে গুরু হিসাবে বরণ করে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রণাম করলেন। গুরুও তাঁর যোগ্য শিষ্যকে আলিঙ্গন করলেন। এর পর শুরু হল গুরুর সঙ্গে অজানার সন্ধানে অন্তহীন পথে যাত্রা।
কামাখ্যা থেকে গুরুর সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন আট-দশ বছর পরে। এই সময়কালে তিনি হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ও অন্যান্য স্থানে পরিভ্রমণ করেন। শ্রীশ্রী রামঠাকুর গুরুর নির্দেশে পাহাড়, মরুপথ পেরিয়ে গভীর অরণ্যের নিরালায় তপস্যায় বসেন। কথিত আছে হিমালয় পর্বতমালায় কখনও কৌশিকাশ্রম, কখনও বশিষ্ঠাশ্রম সহ বহু অজানা স্থানে বছরের পর বছর তপস্যা করে এবং তপস্যারত মুনিদের সেবাপূজায় সময় কাটিয়ে তিনি অষ্টসিদ্ধি অর্জন করেন। এর পর গুরুর নির্দেশে লোকালয়ে ফিরে মানবসেবায় নিয়োজিত হন। গুরুর কৃপায় তাঁর কাছে অগম্য স্থান এবং অজ্ঞাত বস্তু বলে কিছু ছিল না। এর পর গুরু তাঁকে মাতৃসেবার জন্য বাড়ি ফিরতে আদেশ করেন। গুরুর নির্দেশ শিরোধার্য করে নিজের রোজগারে মাতৃসেবার জন্য তিনি নোয়াখালির এক ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে পাচকের কাজ নেন।
শ্রীশ্রী রামঠাকুর নিষ্ঠার সঙ্গে রান্নার কাজ করতেন। সকলকে নিজের হাতের রান্না খাবার খাইয়ে আনন্দ পেলেও তিনি নিজে এ সব কিছুই খেতেন না। সামান্য দুধ এবং দু’এক টুকরো ফলাহারেই তাঁর শরীর ছিল সুস্থ ও সবল। অচিরেই কর্মদাতা ইঞ্জিনিয়ার বুঝতে পারেন, তাঁর বাড়ির পাচক কোনও সামান্য মানুষ নন; এক মহাপুরুষ। শ্রীশ্রীঠাকুরের স্বরূপ জানার পর তিনি তাঁকে আর পাচকের কাজ করতে দেননি।
এরপর শ্রীশ্রী রামঠাকুর ফেণী শহরে এক ওভারসিয়ারের অধীনে সরকারি কাজ নেন। সেই সময় নানা জাতের বহু মহিলা কর্ম সূত্রে ফেণী শহরে থাকতেন। তাঁদের আপন জন বলে কেউ ছিল না। শ্রীশ্রীঠাকুর নিজের হাতে রান্না করে এই সব মহিলাকে যত্ন সহকারে খাওয়াতেন। এদের  কেউ অসুস্থ হলে মা বোনের মর্যাদায় সেবা করতেন। পরসেবায় ছিল তাঁর পরমানন্দ। জেলখানার ইটখোলার ঘরে পাবলিক ওয়ার্কস প্রভুদের আনন্দ দিতে কখনও কখনও বারাঙ্গনারা হাজির হত। শ্রীশ্রীঠাকুর তাদেরও রান্না করে খাওয়াতেন, মাতৃজ্ঞানে সেবাযত্ন করতেন।
তারপরে আবার তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং ১৯০২-০৩ সালে পুনরাবির্ভূত হন কলকাতায়। ১৯০৩ সালে মাতার মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন কালীঘাটে। তারপর কলকাতা উপকন্ঠে নামকরা গ্রাম উত্তরপাড়াতে কয়েক বছর কাটান এবং একদিন সেখান থেকে নিরুদ্দেশ হন। এক বছরের বেশি সময় ধরে পদব্রজে দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণ করে শ্রীশ্রীঠাকুর গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন সম্ভবত ১৯০৭ সালের শেষভাগে অথবা ১৯০৮-এর শুরুতে।
শ্রীশ্রী রামঠাকুর তাঁর জীবনের অর্ধেক সময় লোকচক্ষুর আড়ালে গভীর যোগ সাধনায় মগ্ন ছিলেন। সাধনার মাধ্যমে যে মহাসত্য তিনি উপলিব্ধ করেছিলেন, তা বাকি ৪০ বছর (১৯০৮ থেকে ১৯৪৯) সকলের মঙ্গলে লোকালয়ে বিলিয়েছেন। তাঁর কাছে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শুচি, অশুচির কোনও ভেদ ছিল না। শ্রীশ্রীঠাকুর অবস্থান করেছেন ভক্তের প্রয়োজনে, ভক্তের আলয়ে। লোকালয়ে থাকার প্রায় ৪৫ বছর তিনি মানব মুক্তির দিশা বিতরণ করেছেন। ভক্তদের তিনি বলতেন, আমি আপনাদের জন্য চাইখ্যা ‘নাম’ আনছি।
তিনি বলতেন, পরমপুরুষ 'ব্রহ্ম'-কে পেতে হলে প্রয়োজন প্রভূত অধ্যবসায় এবং কোনও মহাত্মা প্রদর্শিত মত ও পথের অনুশীলন। 'সংসার' ত্যাগ করা আত্ম-উপলব্ধির একমাত্র পথ নয়। কঠোর কিন্তু নিষ্কাম কর্মসাধনায় রত থেকে আমাদের এই পার্থিব জীবনেই আমরা ভগবদ্‌ চেতনা লাভ করতে পারি শুধু 'নাম' শরণ করে।
শ্রীশ্রীঠাকুর সর্বদাই জোর দিয়ে বলতেন ঈশ্বরের পবিত্র নাম বারবার জপ করে যাওয়ার শুভ পরিণামের কথা; নামজপ এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যাবতীয় অমঙ্গলের প্রতিষেধক, কালক্রমে যা আমাদের নিয়ে যায় ঈশ্বর ও অপার শান্তির লক্ষ্যে।
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের শাশ্বত বাণী “শান্ত হইলেই শান্তি পাওয়া যায়।” জন্মান্তরের গতাগতির অবসানে ‘নাম’ই এক মাত্র সম্বল। নাম চিন্তামনিঃ কৃষ্ণচৈতন্য রসবিগ্রহঃ/নিত্য শুদ্ধ নিত্য মুক্ত ভিন্নাত্মা নাম নামিনোঃ। নিত্য শুদ্ধ, নিত্য মুক্ত নাম নির্বিচারে করা যায় যে কোনও স্থানে, যে কোনও সময়ে, যে কোনও অবস্থায়। নামের সঙ্গে থাকিলে সকল অভাব দূর হইয়া ঋণ মুক্ত হইলে তাহাকে আর দেহ ধারণ করিয়া সংসারে আসিতে হয় না। ইহাই কৈবল্য মুক্তি।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কথায়, দীক্ষা হল দেখা। এর দেওয়া নেওয়া কিছু নেই, নিজের জিনিস নিজেকে জানিয়ে দেওয়া। কামনাবাসনা গুরুদক্ষিণা দিতে হয়। আমি উপদেষ্টা নই, দৃষ্টান্ত মাত্র।
শ্রীশ্রী রামঠাকুর অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তিনি একই সাথে দুই স্থানে থাকতে পারতেন, মানুষের মনের কথা পড়তে পারতেন, অদৃশ্য হতে পারতেন। তার এক শিষ্য একবার শ্রীশ্রী রামঠাকুরকে প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা মানুষ কি নিজ শরীর এবং পরিহিত বস্ত্রাদি সহ শূন্যে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে চলে যেতে পারেন ? তো রামঠাকুর উত্তর দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ যে যে স্থান দিয়ে বিদ্যুৎ যেতে পারে, মানুষ ঐ সব স্থান দিয়ে যেতে পারে, এবং একই সময় বহু স্থানে উপস্থিত থাকে পারে।”
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের নির্দেশে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ১৯৩০ সালে কৈবল্যধাম এবং ১৯৪২ সালে কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির যাদবপুরে কৈবল্যধাম তৈরি হয়। এরপরে ঠাকুর শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ রূপে আর এক স্বরূপ প্রকাশ করিলেন। কলিজীবের উদ্ধারের জন্য রামঠাকুর একাধারে শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথ ও আর একদিকে শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণের স্বরূপ প্রকাশ করিলেন।
ঠাকুর একসময় প্রকাশ করিয়াছিলেন, "আমিই ত সত্যনারায়ণ, আমিই ত সত্যনারায়ণ, আমিই ত সত্যনারায়ণ, শত শত ধারাল অস্ত্র নিক্ষেপ করিয়াও আপনাদের কেহই কিছু করিতে পারিবে না।" ১৯৪৩ সালে তাঁর জন্মভিটা ডিঙ্গামানিক গ্রামে সত্যনারায়ণ সেবা মন্দির তৈরি হয়। নামপ্রার্থীদের জন্য এক নির্দিষ্ট প্রথায় মোহান্ত পরম্পরা মারফত নাম বিতরণের তিনি ব্যবস্থা করে গিয়েছেন।
১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি দিল্লিতে মহাত্মা গান্ধী গুলিবিদ্ধ হয়ে ‘হে রাম’ বলে প্রাণত্যাগ করলেন। ঠিক একই সময় নোয়াখালির চৌমুহনীতে ভক্তদের উদ্দেশে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, মহাত্মা গান্ধী চইল্যা গেলেন। গান্ধীর আর জন্ম হইবো না।
স্বাস্থ্য দুর্বল, তবু জীবনের শেষ কয়েক বছর শ্রীশ্রীঠাকুরের মন্ত্র-মন্ত্রণা দানের মাত্রা প্রচন্ডভাবে বেড়ে যায়। শতধারায় উৎসারিত তাঁর করুণা স্পর্শ করেছিল হাজার হাজার মানুষের জীবন।
বাংলা ১৩৫৬ সালের ১৮ই বৈশাখ (ইং- ১লা মে, ১৯৪৯) অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য লগ্নে, নোয়াখালি জেলা অন্তর্গত চৌমুহনীতে অগণিত ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে ৯০ বছর বয়সে শ্রীশ্রী রামঠাকুরের মহাসমাধি হয়। চৌমুহণীর যে-স্থানে তাঁর পবিত্র দেহাবশেষ সমাহিত হয়, তাঁর ইচ্ছা মেনে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি আশ্রম; নাম - 'সমাধি মন্দির'।
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত ডঃ যতীন্দ্রমোহন দাশগুপ্তকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সমুদ্রেরও একটা কূল আছে, কিন্তু তোমার ঠাকুরের কোনও কূলকিনারা নেই।
.

Reviewed by শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ নমঃ(SriSriramthakur O gan Ganer vhovon Youtube channel) on May 07, 2025 Rating: 5

No comments:

শ্রী শ্রী রামঠাকুরেরস্বহস্ত লিখিত পত্রাংশ -দ্বিতীয় খন্ড-223

Powered by Blogger.