স্বর্গীয় ডঃ প্রভাতচন্দ্র চক্রবর্ত্তীর প্রথম ঠাকুর--দর্শনলাভ,স্বপ্নে নামপ্রাপ্তি ও কিছু লীলা-- কথা (স্মৃতিতে রামঠাকুর)ঃ-
১৯১৮ সন।সেই সময় স্বর্গত প্রভাতচন্দ্র চক্রবর্ত্তী মহাশয় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নব গঠিত সংস্কৃতের স্নাতকোত্তর বিভাগে অধ্যাপকরুপে যোগদান করেন।তারই কয়েকমাস পরের ঘটনা।প্রভাতচন্দ্র তখন বহুবাজার অঞ্চলে মলঙ্গা লেনে একটি বাসাবাটিতে বাস করতেন।
সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সময় বাড়ির চিঠির বাক্সে চিঠি দেখে ডালাটি খুললেন।পোস্টকার্ডের পত্র,পত্রের যে পৃষ্ঠায় লেখা তারই দিকে তার চোখ পড়ল,দৃষ্টি আর ফেরাতে পারলেন না।পত্রের পাঠ অনেকটা এই রকমঃআমি নিশ্চিত জানি রাম সাক্ষাৎ ভগবান।আমার ৮০ বছরের উপর বয়স হইয়াছে,সুতরাং আর কতদিন বাঁচিব তাহা জানি না।আমি শুনিয়াছি যে,রাম এখন কলিকাতারই কোনও স্থানে অবস্থান করিতেছেন।মৃত্যুর পূর্বে যাহাতে সাক্ষাৎ নারায়ণ রামের দর্শন পাই তাহার একটু ব্যবস্থা তুমি করিয়া দিবে।এই জন্যই তোমাকে এই পত্র লেখা,যাহাতে তোমার জানা থাকিলে রামের ঠিকানা অতি অবশ্যই শীঘ্র আমাকে জানাইবে।--ইতি যোগজীবন মুখোপাধ্যায়।
পোস্টকার্ডখানি উল্টাইয়া প্রভাতচন্দ্র দেখিলেন যে,পত্রটি পাশের বাড়ির তাহার পরিচিত জনৈক ভদ্রলোককে লেখা।ভুলক্রমে ডাকপিয়ন ওবাড়ির চিঠিখানা তাদের চিঠির বাক্সে ফেলে গেছে।প্রভাতচন্দ্র পাশের বাড়িতে গিয়ে ঐ ভদ্রলোককে ডাকলেন। ভাগ্যক্রমে ভদ্রলোক বাড়িতেই ছিলেন।প্রভাতচন্দ্র তাকে ঘটনাটি খুলে বললেন এবং তাকে না জানিয়ে ঐ পত্র পড়ার জন্য বার বার ক্ষমা ভিক্ষা করলেন।পত্রে লিখিত রামের ঠিকানা তার জানা থাকলে বলবার জন্যও অনুরোধ করলেন।ভদ্রলোক সহাস্যে ঠিকানাটি প্রভাতচন্দ্রকে জানালেন।
বহুবাজার স্ট্রীট ধরে প্রভাতচন্দ্র পায়ে হেঁটে চলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।আর ভাবছেন এই রামের নাম তো তিনি কোনদিনও শোনেননি অথচ পত্রলেখক লিখেছেন রাম সাক্ষাৎ ভগবান।পত্রলেখকের বয়স অশীতিপর,সুতরাং তার অভিজ্ঞতা উপেক্ষণীয় নয়।অধিকন্তু পত্র রচয়ীতা সেই সময়ের সুপ্রসিদ্ধ ধর্মগ্রন্থ "ধর্মসার সংগ্রহের" রচয়িতাও বটেন।সুতরাং প্রচুর পাণ্ডিত্যের অধিকারী তিনি এবং ধর্ম কী তাহা নিয়েও বহু আলোচনা তিনি করেছেন।এহেন ব্যক্তি যখন নিঃসংশয়ে উপলব্ধি করেছেন যে,রাম সাক্ষাৎ ভগবান তখন আর কালবিলম্ব নয়।ঐ ঠিকানায় একবার গিয়ে চেষ্টা করে দেখতে হবে ভগবদ দর্শন ভাগ্যে আছে কী?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস সেদিন প্রভাতচন্দ্রের দু'টোতেই শেষ হয়ে গেল।বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে তিনি ঠিকানাটি লক্ষ্য রেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে চললেন।একে ওকে জিজ্ঞাসা করতে করতে প্রায় পৌনে তিনটা নাগাদ ঠিক ঠিকানায় এসে পৌঁছলেন।দু'টি যুবক গলির সামনে দাঁড়িয়েছিল,প্রভাতচন্দ্রের মুশকিল হলো যে শুধু রাম নামই তার জানা ছিল কিন্তু পুরো নামটি তাড়াতাড়িতে পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়নি।সেজন্য তিনি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েও ঢুকতে ইতস্ততঃ করছিলেন।যুবক দু'টি তার অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন।প্রভাতচন্দ্র তাদের পত্রের সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন।যুবক দু'টি তাকে অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলেন।ক্ষণপরে তারা ফিরে এলেন এবং বললেন--আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন।বলেই দোতলায় উঠে একটি মহিলার সঙ্গে চুপিচুপি কিছু কথা বলে প্রভাতচন্দ্রকে একটি দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, "ইনিই সেই।"
একখানা অতি সাধারণ তক্তপোষের উপর সামান্য বিছানা পাতা।তার উপর সোজা হয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ।পরনে তাঁর আধময়লা একখানা ধূতি,বক্ষ বেষ্টন করে রয়েছে মলিন উপবীত।তাঁর কন্ঠলগ্ন হয়ে রয়েছে তিন গাছা তুলসীর মালা।দুই কর্ণমূলে অতি সামান্য স্বর্ণচিহ্ন।ক্ষৌরকর্ম বোধ করি দিন দশেকের মধ্যে হয় নাই।প্রশস্ত ললাটের নিচে নয়ন দু'টি বড়ই উজ্জ্বল,দৃষ্টি অতি মধুময়।আজানুলম্বিত বাহু প্রসারিত করে তিনি বললেন, "আসেন,আসেন,বসেন।" প্রভাতচন্দ্র ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন।তার চেয়ে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন বৃদ্ধটি।সুতরাং প্রণাম করতে তো কোন আপত্তি নেই।প্রভাতচন্দ্র প্রণামের ইচ্ছা প্রকাশ করতে চারুচরণ দু'খানি তিনি প্রসারিত করে দিলেন।প্রণাম সেরে প্রভাতচন্দ্র মেঝেতে বসলেন,বাধা দিয়ে তিনি বললেন যে,এই বিছানায় স্থান আছে,তিনি এখানে এসে বসুন।উত্তরে প্রভাতচন্দ্র জানালেন যে গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে সিমেন্টের শীতল মেঝেতে বসা অনেক সুখকর।বলেই প্রভাতচন্দ্র তার গলাবন্ধ কোটটি খুললেন। "ফতুয়াটাও খুইল্যা ফেলেন,ওটা তো ভিজা", বললেন বৃদ্ধটি।প্রভাতচন্দ্র তখন আটাশ বছরের যুবক।সম্পূর্ণ অপরিচিতের গৃহে উর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত রাখতে তার দ্বিধা ছিল।ঠাকুরমহাশয় খাট থেকে নিচে নামলেন,বাধ্য করলেন প্রভাতচন্দ্রকে ফতুয়া খুলে রাখতে।পাশের ঘর থেকে একটি হাতপাখা হাতে করে ফিরে এলেন।ফিরে এসে গ্রীষ্মে-কাতর প্রভাতচন্দ্রকে বাতাস করতে লাগলেন।বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত উঠে দাঁড়ালেন প্রভাতচন্দ্র এবং ঠাকুরমহাশয়ের হাত একরকম ছিনিয়ে পাখাটি টেনে নিলেন।বললেন যে,তিনি কে তা তিনি জানেন না,বোঝেননি।তবে এটা তো ঠিক যে তিনি তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়,সুতরাং বয়োজ্যেষ্ঠ পরিশ্রম করে হাওয়া করবেন আর বয়সে কনিষ্ঠ অম্লানমুখে সেই হাওয়া খাবেন,এটা অতি অন্যায়।এ কখনই হতে পারে না।একটু সুমধুর হাসি হেসে ঠাকুরমহাশয় বললেন, " শিশুকালে পিতা-মাতার সেবায় কি আপনে বাধা দিতে পারছেন?" উত্তরে প্রভাতচন্দ্র জানালেন "বাবা-মা তো আপনজন,তারা শিশুকালে অনেক কিছুই করেছেন,কিন্তু পরে কি তাদের থেকে সেবা নেওয়া যায়?" ঠাকুরমহাশয় তখন বললেন, "বাবা-মা আপনের আপনজন,আমি কি পর?" চমকে উঠলেন প্রভাতচন্দ্র,এমন কথা তো ইতিপূর্বে কারও কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হতে শোনেননি।কয়েক মিনিটের মধ্যেই এমন আপন করে নিতেও আর কাউকে দেখেননি।শ্রীরামচন্দ্রের চরণে আকুল হয়ে পুনরায় প্রণাম করলেন প্রভাতচন্দ্র।
ক্ষণকালের জন্য ঠাকুরমহাশয় বাড়ির ভিতরে গেলেন।ঠাকুরমহাশয়ের কন্ঠনিঃসৃত ঘি-ময়দা শব্দটা প্রভাতচন্দ্র শুধু শুনতে পেলেন।ফিরে এসে ঠাকুরমহাশয় বসলেন তক্তপোষে।ভগবান এক ছিলেন সেই তো ভাল ছিল।কেন তিনি বহু হলেন?বহু হতে তাঁকে কে বলেছিল? কেহ ভীমনাগের সন্দেশ পেয়েও খায় না আর কাহারও ভাগ্যে চানাচুর জোটান সম্ভবপর হয় না।...ইত্যাদি,ইত্যাদি।এই প্রশ্ন কয়টি ঠাকুরমহাশয়ের সামনে উত্থাপন করতে প্রভাতচন্দ্রের প্রায় আধ ঘন্টার মত সময় লেগেছিল।
স্থিরভাবেই ঠাকুরমহাশয় সব শুনছিলেন।প্রশ্নশেষে তিনি বললেন, "সকলেই ভ্রান্ত"। ঘন্টাখানেক ঠাকুরমহাশয় স্বর্ণকন্ঠে প্রশ্নের সব উত্তরই দিলেন।দুর্ভাগ্যক্রমে " সকলেই ভ্রান্ত" ছাড়া তাঁহার উত্তরের কোন কথাই আজ আর স্মরণ নাই।মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রভাতচন্দ্র ঠাকুরমহাশয়ের কথা শুনছিলেন।তাঁর আলোচনা যখন শেষ হলো তখন প্রভাতচন্দ্র তৃপ্তচিত্তে ঠাকুরমহাশয়ের চরণ দু'খানি জড়িয়ে ধরলেন।এই সময় একটি মহিলা সামনে এসে বড় একটি ডিসে গরম কুচো নিমকি ও এক কাপ চা প্রভাতচন্দ্রের সামনে রাখলেন।ঠাকুরমহাশয় বললেন, "আপনে খান।" প্রভাতচন্দ্র ইতস্ততঃ করছিলেন,কারণ তিনি সম্পূর্ণ অপরিচিতের গৃহে এসেছেন।এ গৃহে কোন পুরুষের দেখা এ পর্যন্ত তিনি পাননি।দ্বিপ্রহরে এসে নিশ্চয়ই তিনি এদের বিশ্রাম বিঘ্নিত করেছেন।তার উপর আবার উৎপাত করছেন জলযোগের আয়োজন করতে।ঠাকুরমহাশয় পুনরায় বললেন, "সেই সকালে তো খাইয়া আসছেন,তারপর তো আর কিছু মুখে দেন নাই,এখন তো ক্ষুধা লাগছে।মা যা করছেন তা খান।" বিনা দ্বিধায় কুচো নিমকি আর চা প্রসন্ন হয়ে গ্রহণ করলেন প্রভাতচন্দ্র।বিদায় নেবার সময় জিজ্ঞাসা করলেন,আগামীকাল তাঁকে এখানে কি পাওয়া যাবে? মধুর হাস্যে ঠাকুরমহাশয় উত্তরে জানালেন, "এইখানে আর তিন চারদিন আছি,পারলে কাল আইসেন।"
পরেরদিন প্রভাতচন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তার আবাল্য সহপাঠী ও সুহৃদ স্বর্গীয় ডক্টর ইন্দুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং পূর্বের দিনের সমস্ত ঘটনার পুঙখানুপুঙখরুপে বিবরণ দিলেন।পরিশেষে মন্তব্য করলেন "ইনি কে তা জানি না হয়তো শতজীবনেও বুঝতে পারব না।তবে এটা ঠিক এমন জনের কথা ইতিপূর্বে কোনদিন শুনিনি। এমন সস্নেহ ব্যবহার কোথাও পাইনি।আজ আমি সেখানে আবার যাব।আমার একান্ত অনুরোধ এই অমৃতস্পর্শের তুমিও খানিকটা অংশ নাও।" সব শুনে সানন্দে সম্মত হলেন ইন্দুভূষণ।বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে একসঙ্গে দু'জনে উপস্থিত হয়ে ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করলেন।পূর্বদিনের মত ঠাকুরমহাশয় উভয়কেই সমাদরের সঙ্গে গ্রহণ করলেন এবং বহুদিনের পরিচিত আপনজনের মত ব্যবহার করলেন।সে ব্যবহার শুধু সুদুর্লভই নয়,সম্পূর্ণরূপেই পূর্ব অনাস্বাদিত।ঘন্টাখানেক ধরে ঠাকুরমহাশয় অনেক কথা বললেন।কোন কোন অংশ উভয়েরই মনে হলো কিছুটা যেন বুঝতে পারছেন,কিন্তু অধিকাংশ কথাই তাহাদের সম্পূর্ণ বুদ্ধির অগম্য,তবুও বড় ভাল লাগছিল তাদের ঠাকুরমহাশয়ের সান্নিধ্য ও একান্ত আপনজনের মত ঠাকুরমহাশয়ের আচরণ। তাদের মুখে কিছু দেওয়ার জন্য ঠাকুরমহাশয় বার বার বাড়ির ভিতর যাচ্ছেন এবং মেয়েদের তাগিদ দিচ্ছেন। বাড়িতে কুলগুরু এলে সপরিবারে শিষ্যের এমন তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু প্রায় অপরিচিত দু'টি নবীন যুবকের তুষ্টির জন্য একটি বৃদ্ধের এমন কষ্ট স্বীকার,এতো তারা কল্পনাও করতে পারেন না। ঠাকুরমহাশয়কে প্রতিনিবৃত্ত করার জন্য উভয়ে অনেক প্রয়াস পেয়েছিলেন কিন্তু তাদের কথায় তিনি কর্ণপাতও করলেন না।তাদের কিছু খাইয়ে তবে তিনি স্বস্তিবোধ করলেন এবং সেদিনের মত দু'জনকে বিদায় দিলেন,সন্ধ্যা তখন অতিক্রান্ত।
পথে নামলেন দুই বন্ধু। নির্বাক হয়েই উভয়ে পথ চলছিলেন।খানিকক্ষণ বাদে পথ চলতে চলতে উভয়েই নিজের মতামত ব্যক্ত করলেন।ঠাকুরমহাশয়ের সব কথায় দু'জনেই সেদিন একমত হতে পেরেছিলেন। তা নয়,তবে গৃহে ফিরবার সময় উভয়েই একমত হলেন যে,ভাগ্য যদি বিরুপ না হয় তাহলে ঠাকুরমহাশয়ের সংস্পর্শে পুনর্বার তারা আসার চেষ্টা করবেন।দ্বিতীয় দিন ঠাকুরমহাশয়কে দর্শন করার পর,বিদায়ের পূর্বে,ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করে প্রভাতচন্দ্র তার বাসগৃহে একবার পদধূলি দেওয়ার জন্য তাঁকে সকাতর অনুরোধ জানান। "আচ্ছা" বলে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানালেন ঠাকুরমহাশয়।আজ ক'দিন ধরেই প্রভাতচন্দ্র ভাবছেন ভুলক্রমে তার বাসভবনের ঠিকানা সে সময়ে ঠাকুরমহাশয়কে জানিয়ে আসতে পারেননি। ঠাকুরমহাশয় তার বাসভবনে পদার্পণ করবেন আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু ঠিকানা না জানালে তিনি আসবেন কী করে?ক'দিন ধরে প্রভাতচন্দ্র মনে মনে ভাবছিলেন অবিলম্বে তাঁহাকে তার ঠিকানাটা জানিয়ে আসা একান্ত কর্তব্য সেই সঙ্গে তাঁহার পাদস্পর্শের সৌভাগ্যও হবে। পূর্ব দু'দিনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রভাতচন্দ্র বুঝেছিলেন যে কেহ গেলেই ঠাকুরমহাশয় তাকে কিছু খাওয়াবার জন্য অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েন।সম্পূর্ণ অপরিচিতের গৃহে এমনভাবে আপ্যায়িত হতে প্রভাতচন্দ্র সংকোচ বোধ করছিলেন। এই কারণেই মনের প্রবল বাসনা স্বত্তেও যাই যাই করেও তিনি আর ঠাকুরমহাশয়ের সান্নিধ্যে আসতে উপস্থিত হতে পারেননি।
সেদিন সকালবেলা প্রভাতচন্দ্র তার মলঙ্গা লেনের বাসভবনের বারান্দায় বসে সংবাপত্র পাঠ করছিলেন। একবার যেন কড়া নাড়ার শব্দ তার কানে এল।পরক্ষনেই তার জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃবধূ এসে প্রভাতচন্দ্রকে জানালেন,একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাকে ডাকছেন। এত সকালে কে আবার তাকে ডাকে?একটু বিরক্তিতে ভরে উঠল তার মন। সদর দরজার কাছে আসতেই তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন,ছুটে গিয়ে ঠাকুরমহাশয়ের চরণে লুটিয়ে পড়লেন।পরিবারের সকলকে হাঁকডাক করে তিনি জড় করলেন।একে একে সকলেই ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করলেন। ঠাকুরমহাশয় বসলেন খাটের উপর, অন্য সকলে মেঝেতে বসে ঠাকুরমহাশয়ের অমৃতপমো কথা শুনলেন মন্ত্রমুগ্ধের মত।মধ্যে একসময় ঠাকুরমহাশয়কে সামান্য একটু ভোগ দেওয়া হয়েছিল। নামমাত্র গ্রহণ করে তিনি থালাখানি প্রসারিত করে বললেন, "মা,এই প্রসাদ সমভাবে বন্টন কইর্যা আপনেরা পান।"
ঘন্টাদেড়েক পরে সুতীর চাদরখানি গায়ে জড়িয়ে ঠাকুরমহাশয় উঠলেন, বললেন, "এখন আসি গিয়া।" আশ্বাস দিলেন, আবার তিনি আসবেন। যেমন রিক্তচরণে তিনি এসেছিলেন তেমন রিক্তচরণেই পথে নামলেন ঠাকুরমহাশয়। সে সময় কলিকাতায় অল্প পথই পিচঢালা ছিল।খোয়াবিছান পথের উপর দিয়ে ঠাকুরমহাশয় অতি দ্রুতচরণে চলছিলেন। পেছন থেকে তার অনুগামী প্রভাতচন্দ্র বললেন,খালি পায়ে খোয়ার উপর দিয়ে যেতে তাঁর কী খুব ক্লেশ হচ্ছে না?তাছাড়া কলকাতার পথে নানারকম দূষিত বস্তু পড়ে থাকে,খালি পায়ে পথ চলাই শহরে-বন্দরে অতি বিপদজনক। ফিরে দাঁড়িয়ে ঠাকুরমহাশয় বললেন, তাঁর কোন কষ্ট নেই, বিপদের কথা চিন্তা করারও কারণ নেই।বলেই ঠাকুরমহাশয় প্রভাতচন্দ্রকে আর অগ্রসর হতে দিলেন না।তাকে বাসভবনে ফিরে যেতে বলে তিনি অতি দ্রুত চলে গেলেন।
দু'চারদিন পরের ঘটনা। একদা নিশীথকালে নিদ্রিত অবস্থায় প্রভাতচন্দ্রকে ঠাকুরমহাশয় স্বপ্নযোগে নাম দিলেন।পরদিন পূর্বে যে বাড়িতে দু'বার গিয়ে ঠাকুরমহাশয়ের দর্শন পেয়েছিলেন সেখানে গিয়ে প্রভাতচন্দ্র উপস্থিত হলেন। জানতে পারলেন ঠাকুরমহাশয় ও বাড়িতে আর নেই।অনুসন্ধানের পর ঠাকুরমহাশয় যেখানে আছেন তার ঠিকানা পেলেন।অতিব্যস্ত হয়ে প্রভাতচন্দ্র সে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
একখানি ছোট ছাদ,একপাশে একটি চেয়ারে উপবিষ্ট ছিলেন ঠাকুরমহাশয়।সামনে বসেছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত দু'তিনজন ভদ্রলোক। ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করে প্রভাতচন্দ্র করজোড়ে গীতার একাদশ অধ্যায় গদগদ কন্ঠে আবৃত্তি করছিলেন। দু'চোখ দিয়ে তখন তার অশ্রুধারা বহমান। ঠাকুরমহাশয় নির্বাক,নিস্পন্দ।আবৃত্তি শেষে চোখের জল মুছে গত রাত্রে তাঁর দেওয়া নামপ্রাপ্তির কথা জানালেন প্রভাতচন্দ্র। "ঐটা স্বপ্ন নয়,ঐটাই একমাত্র সত্য,বাকি যা আপনেরা দ্যাখেন তাই স্বপ্নের সামিল।" উত্তর করলেন ঠাকুরমহাশয়।
দিন কয়েক পরের কথা।প্রভাতচন্দ্র তাকে স্বপ্নে ঠাকুরমহাশয়ের নাম দেওয়ার কথা তার সহপাঠী,সুহৃদ স্বর্গীয় ডক্টর ইন্দুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে জানালেন। শুনে ডক্টর ইন্দুভূষণ জানতে চাইলেন যে তার কী হয়েছে তা একটু বিশদভাবে তিনি কী বলবেন?উত্তরে প্রভাতচন্দ্র জানালেন যে,এ ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে বলার মত বিন্দুমাত্র শক্তি তার নেই। তবে শুধু এইটুকুই বলতে পারেন যে এই সত্য তিনি দৃঢ়ভাবে অনুভব করেছেন যে আর যাই হোক ঠাকুর ছাড়া তার আর কোন গতি নেই।
জয় রাম। জয় গোবিন্দ।।
Reviewed by শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ নমঃ on December 20, 2024 Rating: 5

No comments:

শ্রী শ্রী রামঠাকুরেরস্বহস্ত লিখিত পত্রাংশ -দ্বিতীয় খন্ড-223

Powered by Blogger.