উড়িষ্যায় জনৈক আশ্রিতের গৃহে ঠাকুরমহাশয় -ঠাকুরমহাশয় জানালেন যে পূর্বে চেষ্টা করলে তেমন ফল হতো না। ঐ মায়ের কাছে আপনার যা ঋণ ছিল তা ঐ দিন শোধ হয়ে গেল।
উড়িষ্যায় জনৈক আশ্রিতের গৃহে ঠাকুরমহাশয় --ঠাকুরমহাশয় জানালেন যে পূর্বে চেষ্টা করলে তেমন ফল হতো না। ঐ মায়ের কাছে আপনার যা ঋণ ছিল তা ঐ দিন শোধ হয়ে গেল।
"রক্ষিতা-মা" কে স্বগৃহে প্রেরণঃ
উড়িষ্যায় কোন এক শহরে জনৈক আশ্রিতের গৃহে ঠাকুরমহাশয় আজ ক'দিন ধরে আছেন। এ বাড়িতে ইতিপূর্বে তিনি বহুবার এসেছেন। সুতরাং বাড়ির সকলেই তাঁহার সুপরিচিত। তারা তাঁহার কাছে আসেন অসংকোচে, কথা বলেন কিছুমাত্র দ্বিধা না করে, হৈ-হল্লা ঠাকুরমহাশয়ের সামনেই করেন তিলমাত্র সমীহ না করে। কারণ তারা জানেন ঠাকুরমহাশয় যে সত্যই তাদের একান্ত আপনজন।
এ গৃহের পরিস্থিতি কিন্তু এবার অন্যরুপ। পরিবারের সকলের চোখে মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। ভয়ে, সংকোচে সকলের মুখ মলিন। গতির স্বাচ্ছন্দ্য নেই, কথাবার্তাও প্রাণ খোলা নয় বরং সব সময়েই অতি ধীরে, সময়ে সময়ে ফিস ফিস করে, কখনও বা আকার ইঙ্গিতে। আরও আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে গৃহস্বামী এ বাড়িতেই আছেন অথচ এর মধ্যে একদিনও তিনি ঠাকুরসকাশে আসেননি। ঠাকুরমহাশয়ের প্রতি তার অপরিসীম শ্রদ্ধা ও অপরিমেয় অনুরাগ ছিল। কাছে পিঠে হোক, অথবা দূর-দূরান্তে হোক, ঠাকুরমহাশয়ের অবস্থানের সংবাদ পেলেই তিনি ছুটতেন এবং অনেক সময় অতি জরুরী কাজও উপেক্ষা করতেন শুধু ঠাকুরমহাশয়ের সান্নিধ্যলাভের জন্য। এবারে তার এই ভাবান্তর কী জন্য? তার স্বগৃহে ঠাকুরমহাশয় আছেন আজ।
কদিন ধরে অথচ ক্ষণকালের জন্য তাঁহার সামনে তিনি উপস্থিত হতে পারছেন না। ঐ শহরের অধিবাসী ও ঠাকুরমহাশয়ের আশ্রিতবর্গ প্রতিদিনই আসছেন সকালে ও বিকালে। তারাও গৃহকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার করতে দোতলায় যাচ্ছেন না। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে দোতলার একটি ঘরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বিরক্তির সঙ্গে তারা অনুচ্চস্বরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন।
গৃহস্বামী দোতলা থেকে নীচে নামেন আনত-মুখে, ওপরে যখন ওঠেন তখন পরিবার পরিজন কাহারও দিকে দৃষ্টিপাত করেন না। কেমন যেন একটি গুরুতর অপরাধীর ছাপ তার মুখে-চোখে। এই ভাবেই আবর্তিত হচ্ছিল এ সংসারের চাকা অমসৃণ পথে।
গৃহকর্তার সম্পর্কে এতদিনেও ঠাকুরমহাশয় কোন খোঁজই নেননি বা দোতলায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও করেননি। পরিবারের কাহাকেও তিনি গৃহস্বামীর বিষয়ে কোন প্রশ্ন করেননি, তারাও সে সম্পর্কে কোন কথা বলেননি। বাড়ির ছেলে ও মেয়েদের সাথে ঠাকুরমহাশয় নানারকম রসিকতা করতেন, এদের মলিনমুখে হাসি ফোটাবার জন্য। রোজকার বাজার করে যা আনা হতো তাতে ঠাকুরমহাশয় খুশি হতেন না।আবার তিনি বাজারে পাঠাতেন আরও মাছ, মাংস প্রভৃতি আনার জন্য, যাতে কোনও রকমে শুধু ক্ষুন্নিবৃত্তি না করে আহারের প্রাচুর্য্যতায় এদের ক্ষীণদেহে পূর্বের সবলতা ফিরে পায়। বিকাল হলে বয়স্কদের ফুটবল খেলার মাঠে পাঠিয়ে দিতেন খেলার জন্য আর ছোটদের নিয়ে তিনি নিজেই খেলাধূলায় মত্ত হতেন। গৃহকর্ত্রীকে নানাবিধ রন্ধনকার্য্যে ব্যাপৃত রাখতেন। তাকে বলতেন যে ওটা তাঁর খেতে ইচ্ছা হয়েছে, ওটা যদি মা রেঁধে দেন উনি খাবেন। ঐ বস্তু রান্না করে থালায় ভরে যখন গৃহের কর্ত্রী ঠাকুরমহাশয়ের সামনে রাখতেন তখন তিনি নিজ হাতে পরিবারের সকলকে একটু একটু করে দিয়ে বাকিটুকু নিজে খেতেন আর বারংবার বলতেন, "মা, রান্না বড় ভাল হইছে, খুব ভাল খাইলাম।" ঠাকুরমহাশয় এইভাবে এই পরিবারের গভীর ক্ষতস্থান না শুকন পর্য্যন্ত সুশীতল প্রলেপ দিয়ে বেদনার উপশম করতেন।
নিশুতিরাত। নগরবাসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, এ বাড়ির সকলেও তাই। নিদারুণ গ্রীষ্মে ঘরে থাকা বড় দায়, তাই গৃহস্বামী ছাদের আলিসাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিলেন আর পাশে দাঁড়ান কালসর্প সম রক্ষিতাটির সঙ্গে কথা বলছিলেন। পিঠে কার স্পর্শ পেয়ে গৃহস্বামী চকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন, ঠাকুরমহাশয় সামনে দাঁড়িয়ে।
স্বজন পরিজনের কাছে দীর্ঘ কয়মাস তিনি মুখ দেখাতে পারেননি। পলাতকের মত কাল কাটাচ্ছেন, কারণ তার ভাগ্যলব্ধ রাহুসম এই রক্ষিতাটি। জ্ঞানে-অজ্ঞানে অনেক অপরাধ তিনি করেছেন, এ তার অজানা নয়। ঠাকুরমহাশয়ও সব অপরাধ ক্ষমা করে চিরদিন তাকে অনুগ্রহই করে এসেছেন। অনুগ্রহ করে ঠাকুরমহাশয় এবারে তার গৃহে বহুদিন ধরে আছেন তবু্ও তিনি একবারও ঠাকুরমহাশয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারেননি। দাঁড়াবেন কী করে? কোন মুখে? অন্যায়ের দুর্ভর ভার বয়ে আজ কয় মাসের মধ্যে তিনি পরিচিত কাহারও সামনে যেতে পারেননি। তিনি জানেন তার অপকর্ম সর্বজ্ঞ ঠাকুরমহাশয়ের অজানা নয়। তিনি ঘৃণ্য অথচ ঠাকুরমহাশয় তাকে পরিত্যাগতো করেননি বরং এই গভীর নিশীতে, অন্ধকারে তিনি যে ওপরে উঠে এসেছেন তা যে শুধু তাকে স্নেহ করেন বলেই। এমনি অকৃপণ দাক্ষিণ্য ঠাকুরমহাশয়ের। আর মোহগ্রস্ত হয়ে তিনি এতদিন ধরে তাঁহাকেই করে এসেছেন বর্জন।
আকুল হয়ে তিনি ঠাকুরমহাশয়ের চরণে পড়লেন। তার পুঞ্জীভূত বেদনার ভার জল হয়ে দু'নয়ন বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ঠাকুরমহাশয় তার পিঠে সস্নেহে হাত বুলাতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে দু'হাত ধরে তাকে তুললেন। বললেন, "আপনি এরকম করছেন, মায়ের মনে কষ্ট হয় না? পরিবারের সকলেই তো লজ্জা পান"।গৃহস্বামী কোঁচায় চোখ মুছচেন আর বিভ্রান্তের মত বলছেন, "কী করি ঠাকুরমহাশয়, কী করি?" তাকে ঠাকুরমহাশয় জিজ্ঞাসা করলেন, ঘরে কত টাকা আছে এবং বললেন, নগদ যা টাকা আছে তার এক কপর্দকও না রেখে এই মায়েরে দিয়ে দেন।
যা টাকা ছিল সব টাকাই গৃহস্বামী ঠাকুরমহাশয়ের হাতে তুলে দিলেন এবং টাকার অঙ্কটা জানালেন। ঠাকুরমহাশয় বললেন, এই টাকাতেই মায়ের বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে কাটবে। বারাঙ্গনা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল, শুনছিল। তার কর্দমলিপ্ত জীবনে মতির পরিবর্তন ঘটল। ঠাকুরমহাশয় সব টাকা বারবধূটির হাতে তুলে দিয়ে বললেন যে মা, এবার আপনি একে ছেড়ে দেন। আপনিও আপনার নিজের গ্রামে ফিরে যান। এই টাকার যা সুদ পাবেন তাতে আপনার খাওয়া-পরার কোন অভাব হবে না। কাঁপতে কাঁপতে বারাঙ্গনাটি বলল, ''হ্যাঁ, আমি তাই করব। আমি এদের অনেক কষ্টের কারণ হয়েছি, আর না।" ঠাকুরমহাশয়ের নির্দেশে গৃহকর্তা ভোর হবার কিছুক্ষণ পূর্বে একখানা গাড়ি ডেকে আনলেন। রক্ষিতাটিকে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে তার গন্তব্যস্থানের একটি টিকিট কেটে নিয়ে ট্রেনে তুলে দিলেন।
রাত ভোর হয়েছে, সকলেই উঠে পড়েছেন। ঠাকুরমহাশয় চাদরখানি গায়ে দিয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথের দিকে পা বাড়ালেন।
এই ঘটনার কয়েক মাস পরে ঠাকুরমহাশয় ঐ বাড়িতে এলেন। একদিন ঠাকুরমহাশয়কে একা পেয়ে গৃহস্বামী তাহাকে বললেন যে ঐ অপদেবীটিকে ঠাকুরমহাশয় ইচ্ছা করলে বহু পূর্বেই তো দূর করে দিতে পারতেন। যে অপরিসীম গ্লানি ও লজ্জা তাকে আমরণ সইতে হবে তাও অনেকটা লঘু হতো। পূর্বে কেন তার স্কন্ধ থেকে এ পাপ বিতাড়নের চেষ্টা ঠাকুরমহাশয় করেননি। কেনই বা তিনি এমন মোহাচ্ছন্ন হয়ে এত দীর্ঘকাল মূর্তিমতী পাপের সঙ্গ করেছেন।
উত্তরে ঠাকুরমহাশয় জানালেন যে পূর্বে চেষ্টা করলে তেমন ফল হতো না। ঐ মায়ের কাছে আপনার যা ঋণ ছিল তা ঐ দিন শোধ হয়ে গেল। তাই এক কথায় তিনিও দূরে সরে গেলেন আর আপনিও তাকে দূর করে দিতে পারলেন।
উড়িষ্যায় জনৈক আশ্রিতের গৃহে ঠাকুরমহাশয় -ঠাকুরমহাশয় জানালেন যে পূর্বে চেষ্টা করলে তেমন ফল হতো না। ঐ মায়ের কাছে আপনার যা ঋণ ছিল তা ঐ দিন শোধ হয়ে গেল।
Reviewed by srisriramthakurfbpage
on
July 31, 2020
Rating:
No comments: